বয়ঃসন্ধিকাল বা কৈশোরে এমন ধারার ভালো লাগা কাজ করতে পারে। এগুলোর কোনো কোনোটি প্রেমে পরিণত হয়। টিনএজ বা ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের এই সময়টাতে শরীর ও মনের নানান পরিবর্তন ঘটে। ইস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরন হরমোন, এন্ডোরফিন, নরএপিনেফ্রিন, ডোপামিন, সেরোটনিনসহ মস্তিষ্কের বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান (নিউরোট্রান্সমিটার) আবেগের নানামুখী পরিবর্তন ঘটায়। ফলে বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষের মনের মধ্যে ঘটে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া; একজন আরেকজনের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করে।
প্রেম বা ভালোবাসার তিনটি মূল উপাদান—অন্তরঙ্গতা (ইন্টিমেসি), উচ্ছ্বাস (প্যাশন) আর দায়বদ্ধতার (কমিটমেন্ট) কোনো কোনোটি তাদের মধ্যে তৈরি হয়। হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর প্রভাবে দুজন টিনএজার বা কিশোর-কিশোরীর মধ্যে জন্ম নেয় পরস্পরের প্রতি তীব্র টান। এই টান যে সব সময় প্রেমে পরিণত হয় তা নয়, অনেক সময় দেখা যায় উচ্ছ্বাসের কারণে অন্তরঙ্গতা বাড়ছে কিন্তু পরস্পরের মধ্যে কোনো দায়বদ্ধতা নেই; ফলে তা সত্যিকারের প্রেমে পরিণত হতে পারে না। নিছক ভালো লাগা, ক্র্যাশ খাওয়া বা মোহ তৈরি হয়।
কম বয়সে আবেগগুলো থাকে এলোমেলো। হঠাৎ করেই একজনকে দারুণভাবে ভালো লাগতে থাকে। মনে হয় তাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন। সব যুক্তি, বাস্তবতা আবেগের কাছে হেরে যায়। প্রেমময় আবেগ যেমন উথলে ওঠে, তেমনি ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি আবেগগুলোর প্রকাশভঙ্গি হয় অনেক সময় অনিয়ন্ত্রিত। তাই পছন্দের মানুষকে পুরো নিজের করে পেতে চায়। এ সময় যদি তৃতীয় কেউ পছন্দের মানুষের মনে ঠাঁই করে নেয় বা কোনো কারণে সম্পর্কটি ভেঙে যায়, তখন ক্রোধ আর হিংসা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। এ সময় আবেগকে সামলে রাখা খুবই জরুরি। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ভয়াবহতম সিদ্ধান্ত নিতে পারে টিনএজ মন। প্রতিপক্ষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে বা তাকে জন্মের মত শায়েস্তা করতে গিয়ে নানা পন্থা বেছে নেয়। কখনো তৈরি করে কিশোর গ্যাং। দলবদ্ধ হয়ে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করে ফেলে! তাই এই বয়সে অবশ্যই আবেগকে সংযত করতে হবে।
কিশোরবেলায়, টিনএজার ছেলেমেয়েদের মধ্যে আবেগের সম্পর্ক মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এই বয়সে শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তনের কারণে পরস্পরের প্রতি আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। বাবা-মায়েরা, স্কুলশিক্ষকেরা বেশির ভাগ সময় কমবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই সম্পর্ককে বড় ধরনের অপরাধ বলে মনে করেন। উত্তেজিত হয়ে বাধা দিতে চান। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা না করে, তাদের বুঝিয়ে না বলে, সম্পর্কটা আসলেই প্রেম কি না, তা না বুঝে উত্তেজিত হলে টিনএজাররা কিন্তু মানসিকভাবে আঘাত পাবে। অভিভাবক আর শিক্ষকদের এই বিষয়টিতে সতর্কতার সঙ্গে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
বাবা-মায়েরা কী করবেন
প্রথমত, মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে যে টিনএজ বয়সে এই আবেগপ্রবণ সম্পর্কটি কোনো অপরাধ নয়। ভালো লাগা, মোহ বা প্রকৃত প্রেম এই বয়সে ঘটতেই পারে। প্রথমে বিশ্লেষণ করে দেখুন এই সম্পর্কটি আসলেই প্রেম, নাকি সাময়িক ভালো লাগা বা মোহ। যদি কেবল ভালো লাগা বা মোহ হয়, তখন সন্তানকে খোলাখুলি ব্যাখ্যা করে জানান যে কেন তার প্রেম টেকসই হবে না। আর যদি মনে করেন তাদের এই সম্পর্কে পারস্পরিক দায়বদ্ধতা আছে, তখন তাদের সম্পর্কটির মূল্য দিন। কিন্তু সব সময় উৎসাহিত করবেন তাদের পড়ালেখাকে। সম্পর্কটি যেন তাদের পড়ালেখার চেয়ে বড় হয়ে দেখা না দেয়।
সন্তানের সম্পর্কের কথা জেনে কখনো রাগ করবেন না, উত্তেজিত হবেন না। সুন্দর অন্তরঙ্গ পারিবারিক পরিবেশে বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করুন। সন্তানের সঙ্গে গুণগত সময় কাটান। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি তাকে জানিয়ে দিন। সম্পর্কটির ভালো-মন্দ আলোচনা করে তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিন আর পড়ালেখাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে উৎসাহিত করুন। যার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক রয়েছে, তার বিষয়ে না জেনে শুরুতেই বিরূপ বা অশোভন মন্তব্য করবেন না, তাকে বা তার পরিবারকে হুমকি দেবেন না।
প্রয়োজনে আপনার সন্তান ও তার পছন্দের সঙ্গীকে একসঙ্গে ডেকে যুক্তি দিয়ে আলোচনা করুন। সন্তানকে বেশি সময় মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকতে দেবেন না, এতে প্রযুক্তি-আসক্তি হতে পারে। যদি মনে করেন আপনার সন্তান কোনো বিপজ্জনক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, তখন তাকে বিপদের লক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করুন। সন্তানের রাগ বা উদ্ধত আচরণের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। একটি সম্পর্ক থেকে সন্তানকে দূরে সরিয়ে দিতে আপনার পছন্দের আরেকজনের সঙ্গে তাকে জোর করে বিয়ে দেবেন না। সন্তানের বয়স অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে তাকে বিজ্ঞানসম্মত সেক্স এডুকেশনের ব্যাখ্যা প্রদান করুন।
কমবয়সী ছেলেমেয়েরা ‘প্রেম’ নিয়ে যেসব সমস্যায় পড়ে থাকে
একতরফা প্রেম
একজন হয়তো আরেকজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, আরেকজনের চিন্তায় দিনমান বিভোর কিন্তু সেই ‘আরেকজনের’ পক্ষ থেকে কোনো সাড়া নেই। তখন প্রেমপ্রত্যাশী ছেলে বা মেয়েটির মধ্যে হতাশা, আবেগের অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
স্থায়ী না হওয়া
এই সম্পর্কের মধ্যে দায়বদ্ধতা না থাকায় বা কিছুদিনের জন্য একজন আরেকজনের কাছ থেকে কোনো কারণে দূরে চলে গেলে ভালো লাগা কমতে থাকে। সম্পর্কটা স্থায়ী হয় না। তখন কারও কারও মন ভেঙে যায়। মনের মধ্যে ঝড় শুরু হয়।
ঈর্ষা আর ক্রোধ
ভালো লাগার মানুষটির সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হলে বা দুজনের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সক্রিয় উপস্থিতি দেখা দিলে ঈর্ষা আর ক্রোধ দেখা দেয়। কম বয়সীদের ঈর্ষা ও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে পরিপক্বতা না থাকায় আগ্রাসী আচরণ দেখা যায়। কখনো অ্যাসিড-সন্ত্রাস আবার কখনো আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ, এমনকি হত্যার মতো নির্মম ঘটনা ঘটে যায়।
নিজের ক্ষতি
পছন্দের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন অথবা সম্পর্ক ভেঙে গেলে একগাদা ঘুমের ওষুধ খাওয়া, হাত-পা কাটা, হাত পোড়ানো, দেয়ালে মাথা ঠোকাসহ বিভিন্নভাবে নিজের ক্ষতি করতে থাকে। এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
নিজেকে গুটিয়ে রাখা
পছন্দের মানুষটিতে বিভোর হয়ে সারাক্ষণ তার সঙ্গে থাকা, ফোনে কথা বলা, দুজনে বেড়াতে যাওয়াতে ব্যস্ত থাকায় অথবা সম্পর্ক নিয়ে লজ্জাবোধের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে এ বয়সী ছেলেমেয়েরা।
ব্যর্থতাকে মেনে নিতে না পারা
সফলতার মতো ব্যর্থতাও যে জীবনের একটি অনুষঙ্গ। তা অনেক সময় টিনএজাররা মানতে চায় না। তখন তারা বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে।
মিথ্যা বলা
সম্পর্কটি গোপন করতে গিয়ে টিনএজ ছেলেমেয়েরা মিথ্যা বলা শুরু করে। একসময় মিথ্যা বলায় তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে পেশাগত ও সামাজিক জীবনেও সে নৈতিকতা হারায়।
প্রতারণা
টিনএজ সময়ে যুক্তির চেয়ে আবেগ অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়। কারও মধ্যে যদি অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তখন সে আরেকজনের সঙ্গে প্রতারণা করে। গোপনীয় বিষয়গুলো জনসমক্ষে ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে নানাভাবে ব্ল্যাকমেল করে। ফলে যে প্রতারিত হয়, সে তীব্র মনঃকষ্টে ভুগে।
অসমবয়সী প্রেম
টিনএজ একটি ছেলে বা মেয়ে তার চেয়ে বয়সে বড় আরেকজন নারী বা পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারে, যা বিভিন্ন ধরনের মনোসামাজিক সমস্যা তৈরি করে।
পড়ালেখার ক্ষতি
টিনএজ ভালোবাসায় যদি উচ্ছ্বাস বেশি থাকে, তখন পড়ালেখাসহ দৈনন্দিন কাজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। স্কুল-কলেজে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
আচরণের পরিবর্তন
মা-বাবার সঙ্গে রাগ করা, জোরে ঘরের দরজা বন্ধ করা, কারণে-অকারণে টাকা চাওয়া, বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া, উচ্চ স্বরে উদ্ধত্যপূর্ণ তর্ক করা, মা-বাবাকে ধাক্কা দেওয়া ইত্যাদি নেতিবাচক আচরণ ঘটতে পারে।
মাদক আর প্রযুক্তি আসক্তি
সারা দিন মুঠোফোনে পছন্দের মানুষটির সঙ্গে কথা বলা, খুদে বার্তা আদান-প্রদান বা চ্যাট করতে করতে প্রযুক্তিতে আসক্তি জন্মাতে পারে। আবার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে গ্রহণ করে ফেলতে পারে মাদক!
ঝুঁকিপূর্ণ শারীরিক সম্পর্ক
শারীরিক সম্পর্কের বিষয় সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান না থাকায় টিনএজাররা জড়িয়ে পড়তে পারে ঝুঁকিপূর্ণ শারীরিক সম্পর্কে। হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
শিক্ষকেরা কী করবেন
টিনএজার বা কিশোর-কিশোরীরা দিনের একটা বড় সময় স্কুল-কলেজে কাটায়। আবার তাদের একটা বড় অংশের প্রেমের শুরুটা হয় স্কুল-কলেজ থেকে। ফলে শিক্ষকদেরও কিছুটা দায়িত্ব আছে। তারা শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে মনোযোগী হোন। লক্ষ রাখুন, কোন বন্ধুত্বটি প্রেমে পরিণত হতে যাচ্ছে। কথায় কথায় মা-বাবাকে ডেকে এনে বিচার-সালিস করবেন না। প্রতিষ্ঠানের দোতলা থেকে একটি মেয়ে একতলার একটি ছেলের সঙ্গে ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান করলেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাদের ওপর চড়াও হবেন না। সহশিক্ষাকে উৎসাহিত করুন।
একই স্কুলে ছেলে-মেয়ে আলাদা শাখা ও আলাদা ক্লাসরুমে বসিয়ে সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দেবেন না। কে ছেলে, কে মেয়ে, তা বিভাজন না করে সবাইকে সহপাঠী হিসেবে ভাবতে শেখান। দুজন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক দেখা দিলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করবেন না, তাদের প্রেমপত্র হাতে পেলে ক্লাসে তা কখনোই পাঠ করবেন না। প্রয়োজনে তাদের ডেকে আলাদাভাবে বসুন। স্কুলের নিয়মগুলো ব্যাখ্যা করুন এবং তাদের পড়ালেখায় মনোযোগী হতে উৎসাহিত করুন।
আবেগকে সংযত রাখতে ছেলেমেয়েরা যা করবে
ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ভালো একটি উপায় হচ্ছে বিকল্প চিন্তার চর্চা। একটি ঘটনা কেবল নিজের দিক থেকে না দেখে চারদিক থেকে বিশ্লেষণ করা এবং ‘রোল রিভার্সাল’ বা আরেকজনের চরিত্রে নিজেকে বসিয়ে বিষয়টির বিশ্লেষণ করা দরকার। ছোট ছোট সমস্যা সমাধানের কৌশল রপ্ত করা, কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শেখা আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি।
প্রেমের ওপর কোনো জোর নেই। দুটি মনের মধ্যে তখনই ব্যাটে-বলে মিলবে, যখন সেখানে আবেগের বহিঃপ্রকাশ হবে স্বতঃস্ফূর্ত। তাই নিজের আবেগকে জোর করে আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। পাশাপাশি আপনি যাকে পছন্দ করছেন, তার আবেগকে সম্মান করুন, তার ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুন। শক্তি প্রয়োগ করে ভালোবাসা আদায় হবে না।
আহমেদ হেলাল: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।