গাজীপুরের শ্রীপুরে বাসার সামনে বেলকুনির পাশে নিজের প্রিয় ফুলের বাগানে পাশাপাশি কবরে মঙ্গলবার দাফন করা হয়েছে নেপালে ইউএস বাংলা বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত এফ এইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন ও তার শিশু কন্যা প্রিয়ন্ময়ীর তামাররাকে। তাদের জানাজায় অংশ নিতে আশপাশের গ্রামগুলোসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষের ঢল নামে।
নিহত প্রিয়কের জেঠাতো ভাই লুৎফর রহমান জানান, নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলার বিমান দূর্ঘটনায় নিহত গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামের ফারুক হোসেন প্রিয়ক ও তার শিশু সন্তান প্রিয়ংময়ী তামারা জানাজা মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় আবদুল আউয়াল কলেজ মাঠে ও বেলা ১১টার জৈনাবাজার এলাকার মাদবরবাড়ি মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এ কলেজেই প্রিয়ক লেখাপড়া করেছেন। জানাজার আগে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদনের জন্য সকাল ৮টার দিকে ওই কলেজের শহীদ মিনার পাদদেশে নিহতদের কফিন রাথা হয়। এসময় প্রিয়কের সহপাঠি, বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনসহ এলাকাবাসী তাদের শ্রদ্ধা জানান।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আক্তারসহ স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাগণ এসময় উপস্থিত ছিলেন। জানাজায় আশপাশের গ্রামগুলোসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েকহাজার মানুষ অংশ নেয়। জানাজা শেষে তাদের লাশ নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাসায় এনে শেষবারের মতো স্বজনদের দেখানো হয়। এ সময় স্বামী-সন্তানের লাশের পাশে প্রিয়কের স্ত্রী এ্যানিসহ স্বজনরা বুক ফাটা আহাজারি করতে থাকে। স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে প্রিয়কের মায়ের ইচ্ছানুযায়ী গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাসার সামনে বেলকুনির পাশে প্রিয়কের প্রিয় ফুলের বাগানে ডালিম গাছের পাশে প্রিয়ক ও তার শিশু কন্যাকে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়। এ বাগান ও বাসাটি প্রিয়কের বেশ প্রিয় ছিল।
স্বামী সন্তান হারা প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগমের ইচ্ছে, বাসার বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে যাতে জীবনের বাকিটা সময় ছেলে ও নাতনির কবর দেখে ও দোয়া করে সময় কাটাতে পারেন। তার ইচ্ছে অনুযায়ি পারিবারিক গোরস্থানে ইতোপূর্বে দাফনকৃত প্রিয়কের বাবার কবরটিও শিগগিরই এখানে স্থানান্তর করা হবে। এছাড়াও প্রিয়কের নির্মিত তিনতলা ভবনের এ বাসার নিচ তলায় বসার কক্ষটিকে একটি মিউজিয়াম করা হবে। যেখানে প্রিয়কের বিভিন্ন শিল্পকর্মসহ তার স্মৃতি বিজড়িত জিনিসগুলো রাখা হবে।
নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলার বিমান দূর্ঘটনায় গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামের ফারুক হোসেন প্রিয়ক ও তার শিশু সন্তান প্রিয়ংময়ী তামারা নিহত হন। একই ঘটনায় প্রিয়কের স্ত্রী অ্যালমুন নাহার এ্যানি ও প্রিয়কের মামাতো ভাই স্থানীয় ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান ও মেহেদীর স্ত্রী সাঈদা কামরুন নাহার স্বর্ণা আহত হন। নিহত এফ এইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন ও তার শিশু কন্যা প্রিয়ন্ময়ীর তামাররা লাশ সোমবার রাত ৮টার দিকে লাশ দুইটি পৃথক কফিনে বন্দী করে একটি এ্যাম্বুলেন্সে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাসায় আনা হয়। নিহতদের লাশ বাড়িতে পৌছার খবর পেয়ে তাদের স্বজন ও এলাকাবাসী প্রিয়কদের বাড়িতে ভীড় জমায়। এসময় অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এর আগে স্বামী-সন্তানকে শেষ বিদায় জানাতে দুপুরে প্রিয়কের আহত স্ত্রী অ্যালমুন নাহার এ্যানিকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অপর একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি নিয়ে আনে স্বজনরা। দূর্ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর এদিনই প্রথমবারের মতো স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর সংবাদটি এ্যানিকে জানানো হয়। এসময় এ্যানি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বারবার মূর্ছা যেতে থাকেন। স্বজনরা তাকে সান্তনা দেয়া চেষ্টা করে। কিন্তু সান্তনা দেয়ার ভাষাও তারা হারিয়ে ফেলেন। অপরদিকে পুত্র শোকে প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগম অনেকটা পাথর হয়ে গেছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি ছেলে ও নাতনির কফিনের পাশে গিয়ে বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন। এ্যানি ও প্রিয়কের মায়ের আহাজারিতে পুরো এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। দাফন কার্যক্রম শেষে এ্যানিকে চিকিৎসার জন্য পূনঃরায় হাসপাতালে ফেরত নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়। বুধবার তাকে হাসপাতালে নেয়ার কথা রয়েছে।
ডিএমসিএইচ’র বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান, বিমান দূর্ঘটনায় আহত এ্যানিকে নেপালে কাঠমান্ডুর হাসপাতালে চার দিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে গত শুক্রবার তাকে দেশে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তিনি মানসিকভাবে যেন ভেঙে না পড়েন সেজন্য স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর খবরটি জানানো হয়নি তাকে। নিহত স্বামী ও সন্তানের লাশ সোমবার দেশে আনা হলে তাদের মৃত্যুর সংবাদ জানানোর জন্য স্বজনরা এ্যানিকে বাড়িতে নিয়ে যান। তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে। এ্যানির ডান গোড়ালিতে ব্যথা রয়েছে, কিন্তু হাড় ভাঙেনি, লিগামেন্টে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তিনি এখন মোটামুটি ভালো আছেন। তবে যেহেতু তার স্বামী ও সন্তান মারা গেছে, তাই তার মানসিক অবস্থা কেমন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। হাসপাতালে তিনি বারবার তার মেয়ের খোঁজ করছিলেন।
প্রিয়কের জেঠাতো ভাই লুৎফুর রহমানসহ স্বজনরা আরো জানান, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতটি দেখা ও বিদেশ ভ্রমণের জন্য গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামের আলোকচিত্রী এফএইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন তার তিন বছরের একমাত্র সন্তান প্রিয়ন্ময়ী তামাররা ও স্ত্রী আলমুন নাহার এ্যানিকে নিয়ে ইউএস বাংলার উড়োজাহাজে চড়ে গত ১২ মার্চ নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হন। একই বিমানে চড়ে ফারুকের মামাতো ভাই ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান অমিত ও অমিতের স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণাও বেড়াতে নেপাল যাচ্ছিলেন। তাদের পাঁচ দিনের সফর শেষ করে গত শুক্রবার দেশে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু তাদের সেই আনন্দ সফর পরিণত হয়েছে বিষাদে। সোমবার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নেপালেই নিহত হন ফারুক ও তার মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী। অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এ্যানি, মেহেদী ও স্বর্ণাকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে নেপালের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চারদিন চিকিৎসার পর গত শুক্রবার প্রিয়কের স্ত্রী এ্যানী, মেহেদী ও মেহেদীর স্ত্রী স্বর্ণাকে নেপালের হাসপাতাল থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তবে জীবিত ফিরে আসেনি প্রিয়ক ও তার শিশু কন্যা প্রিয়ন্ময়ী।