দিনেশ কার্তিক উইকেটে যখন এলেন, তখন প্রচণ্ড চাপে ভারত। ১৮ বলে দরকার ৩৫। কোনো আশা কি আছে? মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর শেষ ওভারটি করেছেন স্বপ্নের মতো—উইকেট মেডেন। কার্তিক মোকাবিলা করবেন রুবেল হোসেনকে, যিনি আগের ৩ ওভারে দিয়েছেন মাত্র ১৩ রান। কিন্তু কার্তিক রুবেলের প্রথম বলটিতেই মেরে দিলেন ছক্কা। ইয়র্কার লেংথে বল করতে চেয়েছিলেন রুবেল, কার্তিক এগিয়ে এসে লো ফুলটস বানালেন। তারপর কী দারুণভাবেই না ছয়ে পরিণত করলেন—যেন ছক্কা মারাটা তেমন কিছুই না।
চাপের মুখে ছক্কা মারা কার্তিকের জন্য বড় ব্যাপার কেন হবে? তিনি তো অহরহই এমন পরিস্থিতিতে পড়ছেন। আইপিএল নামের একটা আন্তর্জাতিক মানের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে নিয়মিত খেলে হাত মকশো করেছেন। ঘরোয়া আরও কিছু টি-টোয়েন্টি লিগেও স্লগ ওভারে মারার অভ্যাস করার সুযোগ পাচ্ছেন। রুবেলের প্র্যাকটিস বলুন আর পরীক্ষা—সবই যে হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। রুবেলও বিপিএল নামের একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলেন, রুবেল খেলেন ক্লাব ক্রিকেটেও। কিন্তু সেই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ কিংবা ক্লাব ক্রিকেট, কোথাও কি আইপিএলের আঁচ আছে? রুবেল যেখানে খেলে নিজেকে তৈরি করেন, সেটি কি আইপিএলের মতো এতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ? আসলে ঘরোয়া ক্রিকেটই পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের ক্রিকেটে।
২০০৮ সালে আইপিএল চালুর পর থেকেই অন্য মাত্রার ক্রিকেট খেলেন ভারতীয় ক্রিকেটাররা। মানসিকতায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। আইপিএল নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বললেও দিন শেষে প্রতিযোগিতাটি যে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ভারতের বিভিন্ন শহরে বড় বড় স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শকের সামনে প্রতিটি ম্যাচে মাঠে নামেন ভারতীয় ক্রিকেটাররা। সেখানে অনেক সময়ই প্রচণ্ড চাপের মুখে তাঁদের পারফর্ম করতে হয়। কার্তিক গত রাতে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে উইকেটে এসেই চাপের মুখে যে খেলাটি খেললেন, সেটি তিনি শিখেছেন আইপিএল থেকেই।
অথচ কাল হয়তো কার্তিক দলেই থাকতেন না। ভারত দলের উইকেটরক্ষকের ভূমিকাটা তো মহেন্দ্র সিং ধোনির। শুধু ধোনিই নন, বিরাট কোহলি, ভুবনেশ্বর কুমার, হার্দিক পান্ডিয়াদের ছাড়াই নিদাহাস ট্রফির মতো একটি প্রতিযোগিতায় ভারত দল পাঠিয়েছে। অনেকটা দ্বিতীয় সারির দল নিয়েই তারা জিতে নিয়েছে প্রতিযোগিতা। প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরে গেলেও পরের ম্যাচগুলো তারা জিতেছে পেশাদারির সঙ্গেই। ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রচণ্ড চাপের মুখেও শেষ পর্যন্ত জয় তুলতে পেরেছে তারা। তথাকথিত দ্বিতীয় সারির দলের এমন পারফরম্যান্স প্রমাণ করে দিচ্ছে, কতটা তৈরি হয়ে তারা এ পর্যায়ে খেলতে আসছে।
কেবল কার্তিকই নন, ভারতীয় দলে এবার বোলিং আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছেন তরুণেরাই। জয়দেব উনাদকাট, শার্দূল ঠাকুর, বিজয় শংকর, ওয়াশিংটন সুন্দর, যুজবেন্দ্র চাহাল। শেষের দুজন তো রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছেন প্রতিপক্ষ শিবিরে। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রতিটি ম্যাচেই ওয়াশিংটন ভীতির সঞ্চার করেছেন ব্যাটিংয়ে। ফাইনালেও এই দুজনের সুবাদেই সংগ্রহটা আরও বড় হয়নি বাংলাদেশের। এঁরা সবাই কিন্তু আইপিএলে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। আইপিএলের চাপ থেকেই এঁরা শিখেছেন।
আইপিএল থেকে এবার চোখ ফেরাই আমাদের বিপিএলের দিকে। ২০১২ সালে অনেক আশা নিয়েই বিপিএল শুরু হয়েছিল। প্রথম আসরটা ছিল বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। প্রতিটি ম্যাচেই দর্শকপূর্ণ গ্যালারি খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করেছিল। ম্যাচগুলো ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ২০১২ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে যাওয়ার পেছনে প্রায় সবাই বিপিএলের অবদানই দেখেন। কিন্তু সেই বিপিএল তো ধীরে ধীরে আলো হারিয়েছে। আইপিএলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না গিয়েও বিপিএলকে আরও পরিকল্পিতভাবে সাজানো যেত, কিন্তু সেটি হয়নি নানা কারণেই। সেটির প্রভাব কিছুটা হলেও তো পড়ছে আমাদের সামগ্রিক পারফরম্যান্সে।
আইপিএলেও বিদেশি ক্রিকেটার খেলেন, বিদেশি ক্রিকেটার খেলেন আমাদের বিপিএলেও। আমাদের বিপিএলে বোধ করি দলগুলো বিদেশিনির্ভর করেই সাজানো হয়। এ কারণে দেশি ক্রিকেটারদের সুযোগ কমে যায় অনেক ক্ষেত্রেই। এটা তা–ও মেনে নেওয়া যেত যদি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোয় খুব উঁচু মানের বিদেশি থাকত। বিদেশি খেলোয়াড়ের মান নিয়েও তো প্রশ্ন আছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে হওয়া বিপিএলের সর্বশেষ আসরে প্রতিটি দলে পাঁচ বিদেশি ক্রিকেটারের অংশগ্রহণ আমাদের দেশি ক্রিকেটারদের সুযোগ আরও সংকুচিত করে দিয়েছে। বলতে পারেন, আমরা বিপিএল থেকে এবার আরিফুল হক ও নাজমুল ইসলামের মতো ক্রিকেটার পেয়েছি। কিন্তু আইপিএল তো প্রতিটি আসরে অনেক বেশিসংখ্যক খেলোয়াড় তৈরি করছে, যাঁরা সরাসরি ভারতীয় দলের হয়ে পারফর্ম করার জন্য তৈরি।
ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাবও আমাদের ক্রিকেটকে ভোগাচ্ছে। ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এখন অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আমরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলি পিকনিক মুডে। ঢাকা লিগে ক্লাবকেন্দ্রিক রেষারেষিটা কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি করলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান যতই শক্ত হয়েছে, আমাদের ক্লাব ক্রিকেট ততই দুর্বল হয়েছে।
ভারতের বিপক্ষে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে হার সবার মন খারাপ করে দিয়েছে। আফসোস-আক্ষেপে পুড়ছে অনেকেই। কিন্তু আইপিএলসহ ভারতীয় ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের ক্রিকেটের তুলনা টানলে ক্রিকেটপ্রেমীদের আফসোস অনেকটাই কমবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপ যে তাদের সেখানে খেলেই শিখতে হয়!