প্রতি বিঘা জমিতে আলু চাষে এ বছর খরচ পড়েছে ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি উৎপাদন হয়েছে ৭৫ থেকে ৮৫ মণ আলু। প্রতি মণ আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে প্রতি মণ আলু বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে। অর্থাৎ প্রতি মণ আলু উৎপাদন করে এ বছর কৃষকের ক্ষতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। বিঘাপ্রতি খরচ দাঁড়িয়েছে সাত থেকে আট হাজার টাকা। আলু চাষ করে বিপাকে পড়েছেন কৃষক।
বিভিন্ন পর্যায়ের আলুচাষি, কোল্ড স্টোরেজের মালিক ও কৃষি অর্থনীতিবিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আলুচাষিদের চলমান কষ্টের মূলে রয়েছে গত বছরের লোকসান। তারা জানান, গত বছর আলু চাষ এবং হিমাগারে সংরক্ষণ করে সংশ্লিষ্টদের ১২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। গত বছর ৩৯০টি হিমাগারে ৫৩ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করে এ লোকসান গোনেন তারা। প্রতি বস্তায় লোকসান হয় ৬০০ টাকা। সরকারের উদ্যোগহীনতায় বছর শেষে ১৫ লাখ টন আলু রয়ে যায় অবিক্রীত। ফলস্বরূপ চলতি বছর সংরক্ষণের উদ্দেশে আলু কেনার মতো লোক পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
আলুচাষি এবং হিমাগার মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশে গত বছর আলুর উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি টনের মতো। কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা আলু বিক্রি করে লোকসান হওয়ায় এ বছর চাষ হয়েছে কম জমিতে। উৎপাদনও গত বছরের চেয়ে কম হবে বলে সংশ্লিষ্টদের অনুমান। মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে যারা কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণ করেন তারা চান কোল্ড স্টোরেজের মালিকেরা তাদের ঋণ দিন। এক মাধ্যমে তারা ঝুঁকি কিছুটা কমিয়ে নিতে চান। কিন্তু হিমাগারগুলোর পক্ষ থেকে ঋণ না দেয়ায় এ বছর বাজারে আলু কেনার লোক কম। কৃষক পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে পাঁচ থেকে সাড়ে ৭ টাকা কেজি দরে। রাজধানী ঢাকার খুচরা বাজারে আলুর দাম এখনো ১৫ থেকে ১৬ টাকা।
বগুড়ার বুড়িগঞ্জ এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, প্রতি বিঘা জমিতে আলু চাষে এ বছর তার খরচ পড়েছে গড়ে ২২ হাজার ৫০০ টাকা। বিঘায় ফলন হয়েছে গড়ে ৮০ মণ। হাটে প্রতি মণ আলু ২২০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এতে বিঘাপ্রতি লোকসান হচ্ছে ছয় হাজার ৫০০ টাকা করে। লোকসানের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এ বছর আলু কিনতে হিমাগার থেকে ঋণ দেয়া হচ্ছে না। তাই হাটে ক্রেতা নেই, দামও কম। অথচ বোরো ধান আবাদের খরচ জোগাতে সস্তায় আলু বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে লোকসান হতে থাকলে আগামী বছরগুলোতে আলু চাষে কোনো আগ্রহই তার থাকবে না বলে জানান রফিকুল।
ব্যবসায়ীরা জানান, হিমাগার মালিকেরা সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফড়িয়া ও কৃষকদের বস্তাপ্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা ঋণ দেন। এতে তাদের হিমাগারে আলু রাখার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। গতবার মওসুম শেষে দাম কমে যাওয়ায় কৃষক ও ফড়িয়ারা হিমাগার থেকে আলু উত্তোলন করেননি। এতে লোকসান দিয়েছেন হিমাগার মালিকেরা। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় এবার তারা ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ঋণ পাননি। তা ছাড়া গতবার হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে মালিকেরা শত শত কোটি টাকা ঋণ ও ভাড়া আদায় করতে পারেননি। ফলে আলু কিনতে তারা ফড়িয়া ও কৃষককে পর্যাপ্ত ঋণ দিতে পারেননি। এতে করে অনেক হিমাগারই খালি পড়ে আছে। আবার বিক্রির অপেক্ষায় কৃষকের কাছে থাকা আলু নষ্ট হচ্ছে।
আলু সঙ্কটের ভয়াবহতার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: মোশাররফ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আলুর সাথে কেবল দেশের পাঁচ কোটি প্রান্তিক চাষিই সম্পৃক্ত নন, কয়েক লাখ আলু ব্যবসায়ী, হাজার খানেক কোল্ড স্টোরেজের মালিক, অর্ধশতাধিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যও এর সাথে জড়িত। গত বছর যারা আলু চাষ এবং সংরক্ষণ করে পুঁজিহারা হয়েছেন, এ বছর তারা আলু চাষ এবং সংরক্ষণে উৎসাহিত হবেন না এটাই স্বাভাবিক। আলু ভাতের বিকল্প আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে চালের জন্য হাহাকার চলছে অথচ আলু খেতে উৎসাহিত করার কোনো কর্মসূচি নেই।
জানা যায়, প্রতি একর জমিতে চাল উৎপাদন হয় ২০ থেকে ২৫ মণ। অন্য দিকে একই জমিতে তুলনামূলক কম খরচে আলু উৎপন্ন হয় ২৫০ থেকে ৩০০ মণ। দেশের সব চাষযোগ্য জমিতে তিন মওসুমে তিনবার ধান চাষ করে চাল পাওয়া যায় তিন কোটি টনের মতো। অন্য দিকে মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে বছরে মাত্র একবার চাষ করে আলু পাওয়া যায় এক কোটি টন। ভাতে অনেক রোগ-শোক লুকিয়ে থাকলেও আলু কেবল খেতেই সুস্বাদু নয়, পুষ্টিগুণের দিক থেকেও এর জুড়ি মেলা ভার। সরকারের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, খোলাবাজারে বিক্রয় (ওএমএস) কর্মসূচি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণে চালের মতো সরকারিভাবে আলু কেনার আহ্বান জানান সংশ্লিষ্টরা।