দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ধরে ঋণের সুদহার স্থিতিশীল ছিল। এ সময় ঋণের চাহিদা কম ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছিল না। ব্যাংকে ছিল প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তহবিল। ফলে ঋণের সুদহার ডাবল ডিজিট অর্থাৎ দুই অঙ্কের ঘর থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কের ঘরে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তিন মাস ধরে ঋণের সুদহার বাড়ছে। বলা চলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪-১৫ শতাংশ উঠে গেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোতেও নগদ টাকার তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সাধারণ গ্রাহক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
প্রশ্ন উঠেছে পাহাড় সমান উদ্বৃত্ত তারল্য গেল কোথায়? আর হঠাৎ করে এমন কী হলো, যার কারণে ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে? কেনই বা ঋণের সুদহার বাড়ছে?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের জন্য তৈরি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার প্রধান তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ তিনটি কারণ হলো আগ্রাসী ব্যাংকিং, ডলার সঙ্কট ও খেলাপি ঋণ।
জানা গেছে, গত বছরের শেষ কয়েক মাসে অস্বাভাবিক হারে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ পণ্য আমদানি করা। এ সুবাদে এক বছরের ব্যবধানে ৪৬ শতাংশ রেকর্ড আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ অস্বাভাবিক আমদানির দায় মেটাতে গিয়ে ডলারের সঙ্কট দেখা দেয়। আন্তঃ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার না পাওয়ায় ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর সঙ্কট মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, প্রায় ১৬৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে তুলে নিয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৩ টাকা হিসেবে)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৬ সালে চার হাজার ৪৮৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছিল। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ তিন লাখ ৭২ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ছয় হাজার ৫৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এ পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা বা প্রায় ৪৬ শতাংশ। দৃশ্যমান বিনিয়োগ না হলেও এ বিপুল আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে ডলারের সঙ্কট দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এক দিকে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, অপর দিকে বাড়েনি কাক্সিক্ষত হারে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহ। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার চেয়ে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়।
এ কারণে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেরই গত বছরের শেষ সময়ে এসে ডলারের সঙ্কট দেখা দেয়। আমদানি দায় মেটাতে প্রয়োজনীয় ডলার না থাকায় আন্তঃ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে একধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। দীর্ঘ দিনের স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতার কারণে আন্তঃ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম বেড়ে যায়। যেখানে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতি ডলার পেতে ব্যয় করতে হয় ৭৭ টাকা থেকে ৭৯ টাকার মধ্যে। কিন্তু গত বছরের শেষ তিন মাসে ডলারের এ দাম প্রথমে ৮০ এবং পরবর্তী সময় ৮৩ টাকা পর্যন্ত উঠে গেছে। অবশ্য আমদানিতে ডলারের দাম আরো বেড়ে গেছে। ডলার সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হয়। মাত্র গত পাঁচ মাসে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ১৬৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। ডলার বিক্রি করে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেয়ায় বাজারে নগদ টাকার সরবরাহে টান ধরে।
এ দিকে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করছে তা আদায় করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, পাহাড় সমান খেলাপি ঋণ থেকে ৩ শতাংশও আদায় হয়নি। আবার নিয়মিত ঋণও কাক্সিক্ষত হারে আদায় হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বড় গ্রাহকেরা ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিচ্ছেন না। ব্যাংকগুলোতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়ে গেছে। নগদ আদায় কম হওয়া বাজারে টাকার সঙ্কটের অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ দরপতনের পর বাজারে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। এ সঙ্কট চলে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না। ওই সময় ব্যাংকগুলো তহবিল সঙ্কট মেটাতে আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠে। ওই সময় ব্যাংকিং খাতে ঘোষণা দিয়ে ঋণের সুদহার বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত নিতে ১৪ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে। এভাবে আমানত বেড়ে যাওয়ায় একপর্যায়ে নগদ টাকার সঙ্কট কমে যায়। কিন্তু ওই সময় কাক্সিক্ষত হারে ঋণপ্রবাহ বাড়েনি। বিশেষ করে ২০১৪ সালের তৎকালীন বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের পর বিনিয়োগের প্রবাহে ভাটা পড়তে থাকে। ফলে ব্যাংকিং খাতে অলস অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। একপর্যায়ে ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ বেড়ে হয় প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। টাকা খাটাতে না পেরে ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে নিরুৎসাহী হয়ে পড়ে। কমানো হয় আমানতের সুদহার। এভাবে আমানতের সুদহার কমাতে কমাতে ব্যাংক রেটের নিচে অর্থাৎ ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে।
এমনি অবস্থায় গত বছরের শেষ দিকে এসে হঠাৎ করে ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট বাড়তে থাকে। ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, এক দিকে ডলারের সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে, অপর দিকে আমানত-প্রবাহ না বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে টাকার সঙ্কট দেখা দেয়। আবার ফারমার্স ব্যাংকের কারণে বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়েই বাজারে টাকার সঙ্কট দেখা দেয়। এ সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে। দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংক ১১ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করায় ঋণের সুদহারও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে ঋণের সুদহার।
ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। যারা মাত্র ২০-২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট, গাড়ি বা ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ করেছিল তাদের প্রত্যেকের মাসিক কিস্তি দুই থেকে তিন হাজার পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এমনি এক ভুক্তভোগী জানান, মাত্র ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তিনি একটি বুটিক কারখানা চালান। মাসে কিস্তি নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯ হাজার টাকা। বেচাকেনা কম হওয়ায় ব্যাংকের মাসিক কিস্তি, কর্মচারীদের বেতনভাতা এবং গ্যাস, বিদ্যুৎসহ ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমনি অবস্থায় ব্যাংক থেকে মাসিক কিস্তি তিন হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন এমনিতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা এ অবস্থায় কিস্তির অর্থ বেড়ে যাওয়ায় তার দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে বলে তিনি মনে করছেন। অথচ যারা শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছেন না তাদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় করতে পারলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ওপর উচ্চ সুদের হারের খড়গ চাপত না। বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা হলে দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক অবস্থার ওপর ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।