বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন নীতি-সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেয়।
গতকাল শুক্রবার নিউইয়র্কে সিডিপি’র ঘোষণা-সংক্রান্ত একটি চিঠি জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে শুক্রবার বিকেলে আয়োজিত এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মাসুদের কাছে এই চিঠি হস্তান্তর করেন সিডিপি’র সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোলান্ড মোলেরাস। আজ ঢাকায় প্রাপ্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
এতে বলা হয়, নিউইর্য়কস্থ জাতিসঙ্ঘ সদরদপ্তরে ১৫ মার্চ সিডিপি’র এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন সংক্রান্ত ঘোষণা প্রদান করে। সে অনুযায়ী শুক্রবার এই চিঠি হস্তান্তর করা হয়েছে।
স্থায়ী মিশনে আয়োজিত অনাড়ম্বর এ অনুষ্ঠানে সিডিপি’র এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ার প্রফেসর হোসে অ্যান্তোনিও ওকাম্পো, জাতিসংঘের এলডিসি, এলএলডিসি (ভূ-বেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ) ও সিডস্্ (উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপ-রাষ্ট্রসমূহ) সংক্রান্ত কার্যালয়ের উচ্চতম প্রতিনিধি আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফেকিতামইলোয়া কাতোয়া উটইকামানু, জাতিসংঘে বেলজিয়ামের স্থায়ী প্রতিনিধি মার্ক পিস্টিন, তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধি ফেরিদূন হাদী সিনিরলিওলু, ইউএনডিপির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক ব্যুরোর পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হাওলিয়াং ঝু এবং ইউএনডিপির মানবিক উন্নয়ন রিপোর্ট অফিসের পরিচালক ড. সেলিম জাহান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন ও নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কর্মকর্তাগণ এবং জাতিসংঘ সদরদপ্তরে কর্মরত বাংলাদেশের কর্মকর্তাগণও এসময় উপস্থিত ছিলেন। কতিপয় এলডিসি দেশের প্রতিনিধিগণ এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সীর কর্মকর্তাগণ উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার উপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়। ভিডিও চিত্রে উঠে আসে জন্মের ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখাতে যাচ্ছে। উঠে আসে জাতির পিতা কীভাবে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে। একে একে তুলে ধরা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। তুলে ধরা হয় পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ। এতে প্রদর্শন করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বান, ‘আসুন দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’
উপস্থিত সুধীজনের উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তৃতায় স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমাদের সকলের জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। অত্যন্ত আনন্দের সাথে আপনাদের জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ এই প্রথম এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের সকল নির্ণায়ক পূর্ণ করেছে।’
এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদন্ডেই উন্নীত হয়েছে।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদন্ড অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থাৎ ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দমমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ।
‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ – যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে আমাদেরকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।’
স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য ইস্তাম্বুল ঘোষণার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অর্ধেক এই ক্যাটাগরি থেকে উত্তীর্ণ হবে এটিই ছিল ইস্তাম্বুল ঘোষণার একটি প্রধানতম উদ্দেশ্য যা এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়ন অর্থাৎ দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি বিনির্মাণের পরিপূরকও বটে।’
রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, ‘কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না – এই প্রতিশ্রুতি ধারণ করে আমরা শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ -আমাদের জন্য শুধু একটি শ্লোগানই নয়, সারা দেশের মানুষ আজ এর সুবিধা পাচ্ছেন। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আজ আমাদের হাতিয়ার।’
বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মর্মে রাষ্ট্রদূত মাসুদ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই যা আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত আকাঙ্খা। আজ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আমরা এসডিজি’র সাথে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাকে একীভূত করেছি। এসডিজি বাস্তবায়নেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এলডিসি থেকে উত্তরণ এসকল দর্শনের সাথে একই সূত্রে গাঁথা।’
এলডিসি ক্যাটাগরির দেশসমূহের এই উত্তরণ প্রক্রিয়া জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাফল্যের স্বাক্ষর বহন করছে মর্মে তিনি উল্লেখ করেন। বাংলাদেশকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার জন্য তিনি জাতিসংঘসহ বাংলাদেশের সকল উন্নয়ন সহযোগীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, উত্তরণকে টেকসই করতে এবং এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নে এই সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকবে।
উত্তরণ প্রক্রিয়ায় থাকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশ তার অভিজ্ঞতা ও সর্বোত্তম কর্মপন্থা ভাগ করে নিতে সদা প্রস্তুত রয়েছে মর্মে স্থায়ী প্রতিনিধি জানান।
চিঠি হস্তান্তরের পর সিডিপি সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোলান্ড মোলেরাস তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের কাঙ্খিত বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সামাজিক খাতগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন এই উত্তরণের ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ প্রদানকে সহজতর করেছে মর্মে উল্লেখ করেন।
সিডিপি এক্সপার্ট গ্রুপের চেয়ার প্রফেসর হোসে অ্যান্তোনিও ওকাম্পো বাংলাদেশের সাফল উন্নয়নের ইতিহাস রয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশের গতিশীল রপ্তানী খাত, মানবক সম্পদ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের ব্যাপক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন।