খেলাপি ঋণ বাড়ছে দুর্বল হচ্ছে ব্যাংক

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

292909_185

 

 

 

 

ঋণ দিয়ে তা আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। এতে ফি বছরই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ঋণের সুদের হারে। কাক্সিত হারে সুদ হার কমাতে পারছে না। আবার ঋণ আটকে পড়ায় ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নতুন ঋণ প্রদান করতে পারছে না। এতে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ছে। কমছে প্রকৃত আয়। এভাবেই দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। ২০১৬ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ১৪০ কোটি টাকা, যা শতকরা ৯ দশমিক ৩১ ভাগ। তবে এর বাইরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এ ঋণ হিসাবে নিলে খেলাপি ঋণ হতো প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। অবলোপকৃত ঋণ মন্দ ঋণ হওয়ায় নীতিমালা অনুযায়ী এসব ঋণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে আলাদা করে রাখা হয়।

বছরের হিসাবে খেলাপি ঋণ বাড়লেও সেপ্টেম্বরের তুলনায় খেলাপি ঋণ কমে গেছে। এর কারণ হিসাবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বছরের শেষ মাসে ব্যাংকের আর্থিক চিত্র ভালো রাখতে ব্যাংকগুলো বিপুল খেলাপি ঋণ নবায়ন করে। একই সাথে সুদ মওকুফ করে ঋণ আদায় বাড়ানো হয়। পাশাপাশি পাঁচ বছরের অধিক এমন খেলাপি ঋণগুলো অবলোপন করা হয়। এ কারণেই সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে মতামত নিতে যোগাযোগ করা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা না করলে ও ঋণের বিপরীতে গচ্ছিত জামানত বাজেয়াপ্ত না করলে খেলাপি ঋণ বাড়তেই থাকবে। তিনি বলেন, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেমন- দেশের ব্যাংকিং খাতে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ছে, যার বেশির ভাগই বড় ঋণখেলাপি। তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে খেলাপির বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিচ্ছেন। আবার অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আবার খেলাপি হচ্ছেন। এভাবেই বছরের পর বছর তারা জনগণের আমানত ব্যাংক থেকে নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছেন না।

আর ঋণখেলাপি হলেও যদি কোনো শাস্তি না পাওয়া যায় তাহলে ঋণ ফেরতই বা দেবেন কেন তারা। তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে ভবিষ্যতে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। আর খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সাথে নিয়ে অর্থঋণ আদালতে ঝুলে থাকা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে প্রধান বিচারপতির সহযোগিতা চাইতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার জন্য আইনগত জটিলতার কথা বলা হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের সবচেয়ে বড় জটিলতা দেখা দিয়েছে আইনগত জটিলতা। শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ে আইনি জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। খেলাপি গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ না করার জন্য বিভিন্ন আইনি ফাঁকফোকর বের করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খেলাপি গ্রাহকরা শ্রেণিকরণ হতে বেরিয়ে আসার জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে শ্রেণিকরণের ওপর স্থাগিতাদেশ নিচ্ছেন। এ সুবাদে তারা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিচ্ছেন। কারণ, একজন ঋণখেলাপি অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন না। এমনকি জাতীয় কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে আইনগত বাধা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো প্রকৃতপক্ষে একজন ঋণ খেলাপিকেই গ্রাহক হিসেবে গ্রহণ করছে। ওই গ্রাহক আবার খেলাপি হয়ে আবার আদালতে মামলা দায়ের করছেন। এভাবে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে তারা আইনিপ্রক্রিয়া গ্রহণ করছেন। এতে ব্যাংকগুলোর জন্য অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে দেখা দিচ্ছে। একই সাথে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর তহবিল সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিচ্ছে তা আদায় হচ্ছে না। আবার আমানত প্রবাহও কমে গেছে। এতে ব্যাংকে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সঙ্কট মেটাতে এক দিকে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে, অপর দিকে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সামনে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত তহবিল হাতে থাকবে না। কারণ, বড় বড় ঋণগ্রহীতারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৯৮ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। এ ঋণ আগের বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে ৪৫ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা বেশি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *