সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে নারীশ্রমিক পাঠানো হলেও মনিটরিংয়ের অভাবে অনেকে নানা সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। নারী কর্মীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হলেও নির্যাতনকারী নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস আইনি ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে; যে কারণে সমস্যায় জর্জরিত নারীদের মধ্যে অনেকে টিকতে না পেরে দেশে ফিরতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে লিখিত অভিযোগ দিচ্ছেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব অভিযোগে তদন্ত শেষ না হতেই রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের পক্ষ থেকে নারীদের নিজ খরচে দেশে ফেরত নিয়ে আসা হচ্ছে।
এ দিকে গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে পাঁচ দিনব্যাপী ২৮ দেশের শ্রম কাউন্সিলরদের সম্মেলনে বিদেশে নারী অভিবাসন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় ও করণীয় নিয়েও সেখানে আলোচনা হয়।
সর্বশেষ নরসিংদীর বাসিন্দা আফিয়া বেগম ঢাকার ফকিরাপুলের ‘রাবেয়া ওভারসিস’ নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে সৌদি আরবে যাওয়ার পর তিন মাস না যেতে তিনি দেশে ফিরতে বাধ্য হন।
এর আগে তার স্বামী জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে এ বিষয়ে অভিযোগ দেন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, সৌদি আরবে গৃহকর্তা ও তার ছেলেসহ অন্যদের হাতে তার স্ত্রী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। কর্মসংস্থান ব্যুরোর উপপরিচালক বুলবুলের দফতরে জমা পড়া অভিযোগের তদন্ত শুরু হতে না হতেই রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক আফিয়া বেগমকে দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করেন।
আফিয়া বেগম গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির উপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে আমি আমার ১৮ মাসের শিশুকে বাড়িতে রেখেই সৌদি আরবে যাই। কিন্তু আমাকে যে বাড়িতে কাজ দেয়া হয়েছিল ওই বাড়ির মালিকের ছেলের কুনজর পড়ে যাই আমি। সেখানে তাই টিকতে পারিনি। এরপর তিন মাসের মধ্যে আমাকে এজেন্ট মোট ৫টি বাড়িতে কাজ দেয়। প্রতিটি বাড়িতেই কাজ করতে গেলে একই সমস্যায় হয়। তিনি মন্ত্রীর সামনে বলেন, আমি খারাপ কাজ করতে রাজি না হওয়ায় আমার ওপর বেশি নির্যাতন হয়েছে।
তিনি নির্যাতনের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে বলেন, সৌদি আরবের এজেন্ট অফিসে এনে হাত-পা বেঁধে আমার পায়ের তালুকে রড দিয়ে ৪১ বার পিটিয়েছে। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লেও তারা আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। পরে সেখান থেকে ফের আমাকে অন্য বাড়িতে পাঠায়। আফিয়া বলেন, শুধু আমি না, আমার মতো হাজার হাজার নারীশ্রমিক সৌদি আরবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমি অনেক নির্যাতনের চিত্র ভিডিও করে নিয়ে এসেছি। তিনি তাদেরকে দ্রুত সেখান থেকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে বলেন, তিনি যে দিন দেশে ফিরেছেন, সেই ফাইটে আরো শতাধিক নারী দেশে ফিরে এসেছেন।
দেশে ফিরে একই কথা জানিয়েছেন বরিশালের আমেনা বেগম। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, বিদেশে যেতে আমার কোনো টাকা লাগেনি। পাসপোর্টটাও দালাল করে দিয়েছে। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর গৃহকর্তার বাড়িতে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তিনি নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পাশাপাশি দূতাবাসের আশ্রয় শিবিরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও গাফলতির অভিযোগ তোলেন। তার দাবি, কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দূতাবাসের শেল্টারহোমকে তাদের ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করেছেন। বিষয়টি সরকারের দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। শুধু আফিয়া ও আমেনা নন, আরো অনেকেই এখনো বিভিন্ন দেশে নারীশ্রমিকেরা সমস্যার মধ্যে আছেন। তবে কী পরিমাণ নারী নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরেছেন, সেই পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরে পাওয়া যায়নি।
বিদেশে নারী কর্মী পাঠানো প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের যেসব নারী কর্মী বিদেশে যাচ্ছে, তাদের মিনিমাম এক মাস ট্রেনিং দেয়ার রেওয়াজ আছে। তবে এই প্রশিক্ষণের সময়সীমা দুই থেকে তিন মাসের হলে ভালো হতো। তার পরও তিনি নারীশ্রমিকদের যেসব সমস্যার কথা উঠছে, সেগুলো কিভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে অবস্থানরত নারী অভিবাসীদের বড় একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। শারীরিক নির্যাতন, পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না পারা, কর্ম ঘণ্টা বেশি, ফোন ব্যবহারের সুযোগ না থাকা অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, লেবার এটাচেসহ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তারা নারী শ্রম অভিবাসীদের বিষয়ে আরো বেশি সংবেদনশীল হবেন। তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় সঠিক ভূমিকা পালন করবেন। নির্যাতিতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াবেন এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে নারীশ্রমিকের সংখ্যা ছয় লাখ ৯৬ হাজার। এদের বড় অংশই সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, জর্দান, লেবানন, কুয়েত ও মালয়েশিয়ায় কর্মরত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারীশ্রমিক সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছেন। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে যেসব নারী গৃহকর্মে কাজ করছেন, তারা সবাই অসহায় দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। অনেকেই বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা।