শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি শহরে মুসলমানদের বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। হামলার পর প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা দেশব্যাপী দ্রুত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। খবর এএফপি’র।
সিরিসেনার কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, অবসরপ্রাপ্ত তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত একটি প্যানেল এ ঘটনা তদন্ত করবেন।
দেশটিতে চার দিনের এই সহিংসতায় তিনজন নিহত ও অপর ২০ জন আহত হন। এ সময় দুই শ’র বেশি ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়।
এদিকে সরকারি কর্মকর্তারা জানান, রাজধানী কলম্বো থেকে ১১৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত ওই জেলার কারফিউ শনিবার ভোর থেকে তুলে নেয়া হলেও সেখানে পুলিশের পাশাপাশি সেনা টহল অব্যাহত রয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় এ দ্বীপ রাষ্ট্রে সামরিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে মুসলিমদের জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।
দেশটিতে কয়েকশ’ বৌদ্ধ ভিক্ষু ও মানবাধিকার কর্মী মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনার শুক্রবার কঠোর নিন্দা এবং তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়েছে।
পুলিশ জানায়, এ দাঙ্গার ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় শ’ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় আতঙ্কিত মুসলিমরা
ব্যাংকক পোস্ট
চার দিন ধরে শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি শহরে মুসলিমদের বাড়িঘর ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে উগ্রবাদী বৌদ্ধদের হামলার পর গতকাল সারা শ্রীলঙ্কার জুমার নামাজের সময় মসজিদগুলোয় সেনা ও পুলিশ প্রহরা বসানো হয়। গতকালও অনেক জায়গায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী বৌদ্ধদের হামলা অব্যাহত ছিল।
ওই সহিংসতায় কমপক্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। হামলার প্রতিবাদে মুসলমানরা তাদের দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন। ক্যান্ডি শহরের কেন্দ্রস্থলে সিংহলি বৌদ্ধ গ্রুপগুলো মুসলমানদের ওপর হামলা চালায়। ক্যান্ডির মসজিদের বাইরে সশস্ত্র সেনা ও পুলিশ টহল দেয়। তবে বেশির ভাগ মসজিদ পুড়িয়ে দেয়া বা তছনছ করায় লোকেরা খোলা চত্বরে নামাজ আদায় করেন গতকাল। কলম্বোর একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘জুমার নামাজের সময় কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি এবং হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সন্ধানে তদন্ত কাজ জোরদার করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, হামলার প্রধান উসকানিদাতাসহ হামলায় জড়িত কমপক্ষে ১৪০ জনকে আটক করা হয়েছে। তারা এর প্রধান উসকানিদাতার নাম জানিয়েছে। মুসলিমবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে অমিথ বিরাসিংঘে নামে ওই সিংহলি। সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিমবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত ছিল।
এক সপ্তাহ আগে মুসলিমদের সাথে সংঘর্ষে আহত একজন সিংহলি মারা যাওয়ার পর গত সোমবার মুসলিমদের ওপর হামলা শুরু করা হয়। হামলায় মুসলিমদের দুই শতাধিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। এ সময় ১১টি মসজিদেও সিংহলিরা হামলা চালায়। এর মধ্যে বাগান ঘেরা পর্যটন আকর্ষণ ক্যান্ডি জেলায় অবস্থিত। এ ঘটনার পর আন্তর্জাতিক পর্যটকরা কান্ডি ভ্রমণ ব্যাপকভাবে বাতিল করছেন।
কান্ডির বাসিন্দারা জানান, শুক্রবার দোকান ও আফিস খুলেছে এবং ধীরে ধীরে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মুসলমানদের তাদের ভস্মীভূত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর, দোকানপাট ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখতে দেখা যায়। শহরের প্রতিটি মোড়ে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন ছিল এবং মোটরসাইকেল ও সাজোয়াযানে করে সেনাদের টহল দিতে দেখা যায়।
ক্যান্ডিতে বন্ধ ইন্টারনেট সার্ভিস গতকাল পুনরায় চালু করা হয়। তবে ফেসবুকের মতো অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখনো সারা দেশে বন্ধ রয়েছে। পুলিশ জানায়, এসব মাধ্যমে চরমপন্থী বৌদ্ধরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে লোকদের উসকানি দিচ্ছিল।
মঙ্গলবার পুড়িয়ে দেয়া ভবনের মধ্যে একজন মুসলমানের ভস্মীভূত লাশ পাওয়ার পর সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। বৃহস্পতিবার সেনাপ্রধান মহেষ সেনানায়েক ক্যান্ডি পরিদর্শন করেন এবং সেখানে মসজিদের কাছে সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
পুলিশ জানায়, সারা দেশে নিরাপত্তা সতর্কতা জোরদার করা সত্ত্বেও ক্যান্ডির ঠিক বাইরে গতকাল সকালেও মুসলিম ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন তিনটি নৌযান পুড়িয়ে দেয়া হয়। তবে এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
শ্রীলঙ্কার পর্যটন বোর্ড দাবি করেছে, বিদেশী পর্যটকদের জন্য ক্যান্ডি নিরাপদ, তবে হোটেল পরিচালকরা বলছেন, তারা বিপুল সংখ্যক পর্যটকের রিজার্ভ বাতিলে মারাত্মক তির মধ্যে পড়েছেন। ক্যান্ডির ডিলাক্স হোটেলের পরিচালক বলেন, ‘আমাদের হোটেলে ৮০ শতাংশ কক্ষ গ্রাহকে পূর্ণ থাকে এখন তা মাত্র ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।’
প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংঘে বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, ৩৭ বছরের গৃহযুদ্ধ বন্ধের পর পর্যটক খাত উন্নয়নের সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি এই সহিংসতা বড় আঘাত হেনেছে। ২০০৯ সালে দেশটিতে মাত্র পাঁচ লাখ বিদেশী পর্যটক এসেছিল। গত বছর আসে ২১ লাখ। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে আসে পাঁচ লাখ পর্যটক।
শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। এতে দেশটির সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধরা সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর হামলা চালায়। দুই কোটি দশ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে সিংহলি বৌদ্ধরা ৭৫ শতাংশ আর মুসলমানরা মাত্র ১০ শতাংশ। বাকিরা তামিল হিন্দু।
বৃহস্পতিবার রাজধানী কলম্বোর রেলস্টেশনের বাইরে সিংহলি ও মুসলমানরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানায়।