আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের জনগণকে আস্থায় আনতে চাইছে আওয়ামী লীগ। উদ্দেশ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হ্যাটট্রিক করা। ঘরে বাইরে যে বক্তব্যই প্রদান করুক না কেন, শেষমেশ আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে- এটা ধরে নিয়েই ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে ক্ষমতাসীন এ দলটি। ইতোমধ্যে সাংগঠনিক সফর শুরু করে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে দলীয় মন্ত্রী-এমপিরা। সুযোগ পেলেই সংসদীয় এলাকায় গিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণের সাথে দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাও মহানগরসহ গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে সমাবেশ করছেন এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এটা অব্যাহত থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সমাবেশগুলোতে শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দেশের জনগণকে আগামী নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আবারো আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর আহ্বান জানাচ্ছেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যেমন বিতর্ক আছে, তেমনিভাবে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্ন রয়েছে। আবার টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে নেতা-মন্ত্রী, এমপি এবং দলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতিসহ একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের মানুষ অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। পাশাপাশি স্থানীয় নেতাকর্মীর সাথেও মন্ত্রী-এমপিদের দূরত্ব তৈরি হয়ে আছে। ফলে নির্বাচনের আগেই নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি জনগণকে আস্থায় এনে ভোটের মাঠে লড়তে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজেই সারা দেশে সমাবেশ করছেন। এর মাধ্যমে বিএনপির সমালোচনার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন তুলে ধরা হচ্ছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে দেশের বেশির ভাগ মানুষ ভোটে অংশ নিতে না পারায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিরা দুর্নীতি, ধর্ম নিয়ে কটূক্তি, মানব সেতুর ওপর দিয়ে জুতা পায়ে হাঁটা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখল ও তাদের ওপর নির্যাতন, শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন এনে ওলামা-মাশায়েখদের ক্ষেপিয়ে তোলাসহ নানা বিতর্কে জড়িয়ে জনগণের বিরাগভাজন হয়েছে আওয়ামী লীগ। এসব নেতিবাচক ইমেজ কাটিয়ে উঠতে নতুন আঙ্গিকে কাজ করছে দলটি। এ জন্য কেন্দ্রীয় নেতারা সুযোগ পেলেই গ্রামে-গঞ্জে দৌড়াচ্ছেন। আর ঢাকাভিত্তিক জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সমর্থন পাওয়ার আশা নিয়ে এলাকায় থাকার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় স্কুল-কলেজ, মাদরাসার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে অনুদান দিচ্ছেন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণের উদ্যোগ, গরিব অসহায় মানুষকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়াসহ এলাকার উন্নয়নে অংশীদার হতে তোড়জোড় শুরু করেছেন।
তারা স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দেশের বড় বড় ফ্লাইওভার নির্মাণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী জোটে অংশগ্রহণ, দেশীয় উগ্রবাদ দমনসহ সরকারের নানামুখী সফলতার চিত্র জোরালোভাবে তুলে ধরছেন। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আনুকূল্য পেতে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা প্রচার করছেন সরকারি দলের লোকজন। বাংলাদেশকে নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনার কথাও তারা বিভিন্ন সভা সমাবেশে তুলে ধরছেন। পাশাপাশি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় নেতা-মন্ত্রীরা জনগণকে ‘দুর্নীতিবাজদের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন।
দলটির নেতাদের মতে, দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। তাদের মতে, আগে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৬০০ ডলার, এখন তা ১৫শ’ ডলারে উন্নীত হয়েছে। রিকশাওয়ালার প্রতিদিনের আয় দুইশ’ থেকে হাজার টাকা হয়েছে, দিনমজুরের আয় দেড় শ’ বা দুই শ’ থেকে পাঁচ শ’ বা ছয় শ’ টাকা হয়েছে। আগে একজন দিনমজুর সারা দিন কাজ করে তিন বা পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারত, এখন তারা ১২ থেকে ১৫ কেজি কিনতে পারে। একজন দিনমজুর আগে সারা মাস কাজ করে সংসার চালাতে হিমশিম খেত। এখন ১৫ দিন কাজ করলে সারা মাস চলতে পারে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্নতা এসেছে।
গত আট বছরে খাদ্য আমদানির দেশ এখন খাদ্য রফতানি করছে, ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতেও দেশ এগিয়ে গেছে। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। তৃণমূল পর্যায়ে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। তাতে সারাবিশ্ব ঘুরে আসতে পারে মানুষ। তরুণরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। দেশ এখন মধ্যম আয়ে প্রবেশ করছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বে প্রবেশ করবে। এসব প্রচারণা এখন নেতাদের মুখে মুখে। নেতারা মনে করেন, বিএনপি নেত্রী দুর্নীতি মামলায় কারাগারে আছেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে লন্ডনে রয়েছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত ও সন্ত্রাসীর তকমা পাওয়া দলটির বিষয়ে সঠিকভাবে বোঝাতে পারলে জনগণ আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেবে না।
এ ছাড়া আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ওলামা মাশায়েখদের সাথে জিইয়ে থাকা দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীনরা। ইতোমধ্যে আলেম-ওলামার সাথে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বেশ কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে, দেশের ইসলামপন্থী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে আওয়ামী লীগের ইমেজ ভালো না। গত কয়েক বছরে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চলমান নিপীড়ন পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করেছে। সরকার একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জনমত জরিপ করে দেখতে পায় বেশির ভাগ মানুষই সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমকে ইসলামবিরোধী মনে করে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে ভোটে এর প্রভাব পড়বে। এ অবস্থায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনোভাবের পরিবর্তন আনতে গেলে প্রচারণার ওপর জোর দেয়ার পাশাপাশি ওলামা মাশায়েখদের আনুকূল্য পাওয়া খুবই প্রয়োজন বলে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এ জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ব্যানারে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইতোমধ্যে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং হেফাজতের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফীসহ বিশিষ্ট ওলামা মাশায়েখদের সাথে গণভবনে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে কওমি সনদের স্বীকৃতিও দেয়া হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আনুকূল্য পেতে সৌদি সরকারের অর্থায়নে দেশের ৬৪ জেলায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নেতারা মনে করছেন, ওলামা- মাশায়েখদের মাধ্যমে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মন জয় করতে পারলেই কেবল আগামী জাতীয় নির্বাচনে নৌকার পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হবে। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে বড় ধরনের সাফল্য আসবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, দেখুন বাংলাদেশের ইতিহাসে যে পরিবর্তন হয়েছে গত ৪০ বছরেও তা হয়নি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্নতা এসেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে এখন আর কুঁড়েঘর নেই, কুঁড়েঘর এখন কবিতায়, গল্পে আছে। প্রতি ইউনিয়নে হাজার খানেক মানুষ সরকারি ভাতা পাচ্ছে। এই যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে সারা দেশে। মানুষের বুদ্ধি আছে, চোখ আছে, কান আছে, আমরা মনে করি না দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ছাড়া এখন অন্য কাউকে সমর্থন করতে পারে।
তিনি বলেন, লক্ষ্য করবেন, আগামী নির্বাচনের লক্ষ্যেই সব নেতা ও দলের এমপিরা আগের চেয়ে এলাকায় যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন। জনসম্পৃক্ততামূলক কাজে অংশ নিচ্ছেন। উদ্দেশ্য দেশের অবস্থান আগে কোথায় ছিল, এখন কোথায় আছে তা জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয়া। যারা জ্বালাও পোড়াওয়ের রাজনীতি করেছে, যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে তারা কি আগামী দিনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেতে পারে? সেই বিষয়টি মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
শুক্রবার কুষ্টিয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে মতবিনিময় শেষে নিজ বাসভবনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি সাংবাদিকদের বলেন, বেগম খালেদা জিয়া এতিমের টাকা আত্মসাতের মামলায় ইতোমধ্যে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়েছেন। দণ্ডপ্রাপ্ত একজন আসামির আইন অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। আইনানুগভাবে যাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা থাকবে তারাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।