বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজার পর দেশের ভেতরে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এমন আশঙ্কায় সরকার আগাম নানা প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়নি। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যে পরিকল্পনা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এগোচ্ছিল, তা বাস্তবায়নে এখন অনেকটাই নির্ভার দলটি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার রায় এবং তা বাস্তবায়ন আওয়ামী লীগের জন্য একটা বড় রাজনৈতিক পরীক্ষা ছিল। এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারে—এমন আশঙ্কায় সরকার বাড়তি প্রস্তুতিও রাখে। কিন্তু দেশের ভেতরে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বিএনপি শক্ত কোনো অবস্থানে যায়নি। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহজে সামাল দিয়েছে। নতুন করে কঠিন কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে—আপাতত এমন কোনো আশঙ্কা করছে না সরকার। এরপরও প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রস্তুতি নেওয়া আছে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেপ্তার অব্যাহত রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সাজা এবং কারাগারে পাঠানোর পর আন্তর্জাতিক মহল থেকেও বড় কোনো প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত নেই। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন নয়। খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পরদিন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বাংলাদেশ সফরে আসেন। কিন্তু তিনিও খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে কিছু বলেননি বলে জানা যায়।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার রায়ের পরপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রায়ের সংক্ষিপ্তসার এবং এর বিশ্লেষণ বিদেশে বাংলাদেশের সব কটি মিশনে পাঠানো হয়েছে। ওই সব দেশকে প্রয়োজন অনুসারে অবহিত করতে দূতাবাসকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকেরা আগ্রহ দেখালে তাঁদের অবহিত করার প্রস্তুতিও আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী একাধিক দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ভবিষ্যতে যাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না হয়, সে জন্য সরকার ও দলের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালু রাখা হচ্ছে। আগামী ১০ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফরে যাচ্ছে। এই দলে কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব নেতাই থাকছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, খালেদা জিয়ার সাজার রায় হওয়ার পর বিএনপির দিক থেকে তিনটি বিষয় কাজ করেছে। ১. হয়তো তারা উপলব্ধি করেছে যে সহিংসতা করে রাজনীতিতে টিকে থাকা যাবে না। ২. নেতা-কর্মীরা হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে দুর্নীতি করেছেন। ৩. ২০১৫ সালে যারা বেশি সাহস দেখিয়ে সহিংসতা করেছে, তাদের হয়তো মোহভঙ্গ হয়েছে। এসব কারণে সরকারের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করছে। এ জন্য খালেদা জিয়া ও বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তিনি বলেন, সরকার ফাঁদ পেতেছিল যে রায় হলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সহিংসতা করবে, যা নিয়ে অপবাদ দেওয়া হবে। বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করায় সরকার হতাশ। এরপরও তারা যদি খুশি হয়, তাহলে খুশিতেই থাকুক। সময় হলে বুঝতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববার ইতালি সফরে গেছেন। দেশে ফিরে ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজশাহী সফর করবেন। সিলেট ও বরিশালের পর এটি তাঁর তৃতীয় নির্বাচনী সফর। আগামী শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফরও আছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচনী প্রচারের জন্য গঠিত ১৫টি দল গত ২৬ জানুয়ারি সফর শুরু করে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার এসব সফর হওয়ার কথা। কিন্তু খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহে তা বন্ধ ছিল।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খালেদা জিয়ার রায়টা এমন একটা সময়ে এসেছে, যখন বিএনপিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা ভাবতে হচ্ছে। সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমে নির্বাচন পর্যন্ত টিকে থাকার মতো সাংগঠনিক শক্তি তাদের নেই। এ জন্য তারা কঠিন প্রতিক্রিয়া দেখানোর পথে হাঁটেনি। এখন খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘ হলেও সরকারের শঙ্কার কিছু নেই। অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে আছে। এ জন্য দেশের বাইরের প্রতিক্রিয়া এতটা জোরালো হয়নি। ২০১৫ সালে খালেদা জিয়াকে গুলশানের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখার সময়ও এর চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া এসেছিল।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রায়ের পর বিএনপির প্রতিক্রিয়া বা আচরণ ইতিবাচক। এতে সরকারের খুশি বা নির্ভার হওয়ার কারণ নেই। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার ফলে রাজনীতিতে অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে। সরকারকে এটা মাথায় রেখেই নির্বাচনে যেতে হবে। আর খালেদা জিয়ার কারাবরণের সঙ্গে রাজনীতি নেই, এটা প্রমাণ করার জন্য অন্য দুর্নীতিবাজদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মূল্যায়ন হলো সরকারের প্রথম দুই বছর গেছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কৈফিয়ত দিয়ে এবং বিএনপির সহিংস আন্দোলন মোকাবিলা করে। এরপরের বছর রাজনৈতিকভাবে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। চতুর্থ বছরে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আগমন এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা সরকারের জন্য বড় ধাক্কা ছিল। পঞ্চম বছর শুরু হয় খালেদা জিয়ার মামলার রায় এবং তা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ দিয়ে। একই সঙ্গে চলছে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত সাত-আট মাস সরকারকে বেশ কিছু কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। এরপর গত বৃহস্পতিবার দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা ও তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে সরকারের নির্বাচনী পরিকল্পনার একটা ধাপ শেষ হলো। তার আগে মো. আবদুল হামিদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার মাধ্যমে ভালো একজন অভিভাবক নিশ্চিত করা গেছে। সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফলে বিচারাঙ্গনে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তার একটা সমাপ্তি ঘটেছে। পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে জাবেদ পাটোয়ারীর নিয়োগও পরিকল্পনামতো হয়েছে। ফলে এখন আওয়ামী লীগ অনেকটা নির্ভার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, খালেদা জিয়ার রায়ের পর আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার বা আওয়ামী লীগ নিজেদের নির্ভার ভাবতে পারে। তাদের এই নির্ভারের পেছনে কৌশল বা শক্তিমত্তার বিষয় আছে। কিন্তু সমাজ কি নির্ভার হয়েছে? এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, সার্বিক রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে, অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে গেছে। কারণ, শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা নির্বাচন অনুষ্ঠানই সব নয়। প্রতিযোগিতাহীন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হলে জবাবদিহি কমে যায়। সুতরাং, কে নির্ভার ও কারা নির্ভার, এটাও বিবেচনার বিষয়।