আজ ফাগুনের প্রথম দিন। বসন্ত-বাতাসে ফুলের সুবাসে মন আনচান করার দিন আজ। গাছে গাছে ফুল ফুটুক আর নাই- বা ফুটুক, বসন্ত তার নিজস্ব রূপ মেলে ধরবেই। ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে বাঙালি তার দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত হবে।
বসন্তকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলায় নানা বাঙালি আয়োজনের সমারোহ থাকে। বাসন্তী রঙের শাড়ি, হলুদ রঙের পাঞ্জাবি আর রঙ-বেরঙেয়ের ফুলের সাজসজ্জা নানা মাত্রিকতায় বর্ণিল করে তোলে। শীতের সঙ্গে তুলনা করে চলে বসন্তকালের পিঠা উৎসবও। তবে বসন্ত উৎসব আজ গ্রামীণ আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। শহুরে মানুষের কাছেও বসন্তের আবেদন ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে শহরের তরুণ-তরুণীরা বসন্ত বরণে দিনভর ব্যস্ত থাকে। ফুলে ফুলে ভরে যাবে তরুণীর চুলের খোপা। শহরের বিভিন্ন জায়গায় বসবে খাবারের মেলা। এ দিন দর্শনীয় স্থানগুলোতে মানুষের পদচারণায় যেন তিল ধরার ঠাঁই থাকে না।
আবহমান বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যের উল্লেখযোগ্য ঋতু বসন্ত। বসন্তের মাতাল সমীরণের টকটকে লাল বর্ণচ্ছটায় মন রাঙানো শিমুল-পলাশ প্রকৃতিতে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা। চারপাশে যেন সুখকর উৎসবের রোমাঞ্চ। পলাশ, শিমুলেরা পাপড়ি মেলে ধরেছে গাছে গাছে। আম্র-মুকুলের মনকাড়া গন্ধে বসন্তের রং লেগেছে বেশ আগেই। বসন্তকে স্বাগত জানিয়ে রিক্ত হস্তে শীত বেলার বিদায় লগ্নও ঘটছে আস্তে আস্তে। এখন শুধুই ফাগুন বরণে হৃদয় রাঙানোর পালা।
ফুল নিয়ে বাঙালির মাতামাতি পুরনো। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভক্তিতে ফুল যেন তুলনাহীন। ফুলে প্রেম নেই- এমন মানুষ মেলানো ভার। তবে দিবসগুলোত ফুলের কদর যে দিন দিন বেড়েই চলছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তেমনি পলাশ-শিমুল ফাগুনের ফুল-বসন্তের ফুল-ভালোবাসার ফুল। বাঙালির সংস্কৃতির আবাহনে হৃদয়কে সাজায় পলাশ-শিমুলের লাল আভা। প্রেম-ভালোবাসার মধুরিমায় শিমুল পলাশেরা ছন্দায়িত করে তোলে মন। তবে সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি বাংলার দৃশ্যপট আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে অনেকটা হারিয়ে যাওয়ার পথে এই প্রকৃতি সমৃদ্ধ করা গাছগুলো। মানিকগঞ্জের প্রায় সব গ্রামেই এই ফুলের দেখা মিলতো। এখন ফাগুনের আগুণ রাঙা এই ফুলের দেখা পাওয়া খুবই দুস্কর। অনেকের মতে এটি ফলজ বৃক্ষ নয়, শুধু ফুলের সৌন্দর্য। এছাড়াও এই গাছের কাঠ জ্বালানি ছাড়া কোন কাজে আসে না বলে এই গাছ লাগাতে মানুষের এত অনীহা।
বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। বাংলার প্রকৃতি, আমাদের ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বড় স্থান দখল করে আছে বসন্ত। জীবন রসায়নে যেন কী এক পরিবর্তন আসে। হৃদয়ে সৃষ্টি হয় প্রণোদনা, নাড়া দেয় এক অব্যক্ত আবহ। কেবল মানব মানবীর মনেই নয় বৃক্ষরাজি, পক্ষী ও প্রাণিকূলেও এ হাওয়া দোলা দেয়।
পলাশ, শিমুল গাছে লাগে আগুন রঙের খেলা। প্রকৃতিতে চলে মধুর বসন্তে সাজ সাজ রব। এ দিনেই রমণীরা বাসন্তী রঙে রাঙিয়ে ঘুরে বেড়াবে মনানন্দে।
মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে গায়ের মেঠো পথের ধারে অযত্নে অবহেলায় শিমুল পলাশের কোলজুড়ে হেসে ওঠেছে রক্তিম ফুল। বর্তমানে অনেকটা হারিয়ে যাওয়ার পথে এই গাছগুলো। আগে গ্রাম গঞ্জের সবখানে এই ফুলের দেখা মিললেও এখন দেখা পাওয়া খুবই দুস্কর। আবহমান বাংলার প্রকৃতির রূপ ও দীর্ঘদিনের পাালিত সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পলাশ-শিমুল গাছ টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
কবির ভাষায় বলা যায়, ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গায়…।’ রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/তোমার অশোকে কিংশুকে/অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে…’।
বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। হলুদ ও বাসন্তী রঙের সাজ-পোশাকে নারী-পুরুষের সরব উপস্থিতি জানান দিয়ে যায় পয়লা ফাল্গুন। মিলনের ঋতু বসন্তই মনকে সাজায় বাসন্তী রঙে, মানুষকে করে আনমনা। এছাড়াও রাত পোহালে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও। দু’দিনের উন্মাদনায় মাতবে দেশ। তাই তো দিকে দিকে চলছে নানা আয়োজন।
ফাগুনের আগুন নিয়ে রিক্ততা ভুলিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে বাঙালির জীবন রাঙাতে। গাছের কচিপাতা আর কোকিলের কুহুতানে, মাতাল হাওয়া, উড়াল মৌমাছিদের গুঞ্জরণ আজ জেগে ওঠার দিন। তবে এবারো ফুল ফুটেছে। দখিনা হাওয়ার গুঞ্জরণও লেগেছে। শীতের জরাগ্রস্ততা কাটিয়ে নতুন পাতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠছে রিক্ত বৃক্ষাদি।