শঙ্কায় আগামী নির্বাচন

Slider রাজনীতি

293212_178

 

 

 

 

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায়-পরবর্তী পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তারা মনে করছেন, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের বিষয়টি প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির ময়দান এই ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি ছিল রাজনৈতিক। এই মামলার আইনগত ভিত্তি যে দুর্বল তা এর কার্যক্রম চলাকালে প্রকাশ পায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রসিকিউশন ও অন্যদের গতি-প্রকৃতিতে সবাই ধারণা করেছিল এই মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হতে পারে। বেগম খালেদা জিয়াও মামলার প্রতিটি কার্যদিবসে অংশ নেয়াসহ তার রাজনৈতিক পরিকল্পনা ঢেলে সাজান। রায়ের পূর্ব দিনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি পরিষ্কারভাবে তার অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি যে এই রায়ে ভীত কিংবা বিচলিত নন সেটা উল্লেখ করে এ জন্য তার প্রস্তুতির কথা বলেন।

রায়ে বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের জেল ঘোষণা হলে তিনি সবাইকে সংযত প্রতিক্রিয়ার আহ্বান জানান। সরকারের পক্ষ থেকে একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা সত্ত্বেও অবিচলভাবে বেগম খালেদা জিয়া পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি আদালতে যান এবং ইতিবাচক রাজনীতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। সরকারের মারমুখী ভূমিকার বিপরীতে বেগম জিয়ার এই দৃঢ় ও অবিচল অবস্থান সাধারণ মানুষের মাঝে তার নতুন পরিচয় তুলে ধরেছে। তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলেই অনেকের মত।

নির্বাচনের এ বছরে বিএনপির মতো বৃহত্তর একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের কারাদণ্ড রাজনীতির জন্য খুব একটা সুখকর নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের একটি বিতর্কিত অতীত এমনিতেই তাড়া করে ফিরছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে ওই নির্বাচনকে যতটাই বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে মাপার চেষ্টা করুন না কেন, ভেতরে তারা সঙ্কোচহীন নন। এমন একটি প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেবে, এমন প্রত্যাশার পারদই চেপেছে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও চিড় ধরেছে।

বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এমনটিই ধারণা করা হচ্ছে। দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম অন্তত তাই বলে আসছে। যদি খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন এবং বিএনপি যদি এই অবস্থানে অনড় থাকে, তাহলে কেমন হবে সেই নির্বাচন তা নিয়ে শঙ্কা এখনি উঁকি মারছে।
খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকারি দলের মতিগতি কিংবা রাজনৈতিক কৌশল কিছুটা হলেও আঁচ করা যাচ্ছে। কেউ কেউ এ কৌশল ব্যাখ্যা করে বলছেন, সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে আগামী নির্বাচনে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশসহ প্রভাবশালী দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীরা বারবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে তাগিদ দিয়ে আসছে, সে বিষয়টি উপেক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। ফলে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে সরকারের নানা কৌশল কিংবা তোপ গিয়ে পড়ছে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ওপর।

সরকারি দলের কাছে তথ্য রয়েছে, সামনে যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। আর সেই নির্বাচন যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়, তাহলে ২০১৪ সালের মতো অবস্থা নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ কঠিন হয়ে যেতে পারে। এ কারণে বেগম জিয়াকে আটক রেখে বিএনপির দুর্বল অবস্থানকে নির্বাচনের মাঠে পুঁজি হিসেবে কাজে লাগানো এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের যে বিরূপ মনোভাব আছে সেটা যাতে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে না পারে তা নিশ্চিত করা সরকারি দলের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে বলে অনেকের মত।

এক-এগারোর পর থেকে গত ১০ বছর রাজনৈতিক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে কাক্সিক্ষত ফল না পেলেও দলটি সীমিত আসন নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। ওই নির্বাচনের আগে ও পরে আন্দোলনে ব্যর্থতা এবং একই সাথে সরকারের দমন-পীড়নে বিএনপি অনেকটাই চাপে পড়ে যায়। তবে নীরবে গত দুই বছরে দলটি সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। দলটির লক্ষ্য একাদশ সংসদ নির্বাচন। সে কারণেই খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের পরেও বিএনপি সাংঘর্ষিক কোনো কর্মসূচিতে যায়নি। নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনের পরামর্শ দিয়েছেন নেতারা। একই সাথে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে কিভাবে দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে দিকে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

তবে বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, যদি খালেদা জিয়ার জামিন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়, তাহলে দলটি কর্মসূচির ধরন পাল্টে ফেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নতুন মোড় নিতে পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি। দেশে একটি অস্বাভাবিক ও অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। এর পরিণতি স্বাভাবিক হয় না। বেগম খালেদা জিয়ার রায় এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তিনি বলেন, ইতিহাসে অনেক কিছুরই পুনরাবৃত্তি ঘটে। নির্মম হচ্ছে আমরা কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। ১৯৯৬ সালে দেশে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধ ছিল। ২০০৬-০৭ সালে একই ইস্যুতে বিরোধ সৃষ্টি হয়। যারা সরকারে থাকেন তারা সংবিধানের কথা বলেন, আবার সরকারের বাইরে যারা থাকেন তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের। ২০১৩-১৪ সালেও এ বিতর্ক ছিল। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের এখানে এ নিয়ে বিতর্ক কোনো সময় কম ছিল না। ২০১৪ সালে একটি বিতর্কিত ও হাস্যকর নির্বাচন আমরা দেখেছি। এসবই পরিবেশকে অস্বাভাবিক ও অস্থিতিশীল করেছে। যে স্বাভাবিক সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণ প্রত্যাশা করেন তা হচ্ছে না। শঙ্কা এখানেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল নয়া দিগন্তকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মামলার গতিপ্রকৃতি ও আলামত দেখে মনে হচ্ছে, নির্বাচনী বছরের পুরোটা জুড়েই তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করা হবে। সরকার বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তায় ভীত বলে মনে হচ্ছে। তারা দেখেছে, এককভাবে বিএনপি নির্বাচনে এলে সরকারের জন্য তা মোটেও ভালো ফলদায়ক হবে না। তারা চায় এজন্য একটি দিকনির্দেশনাহীন, বেগম খালেদা জিয়াবিহীন খণ্ডিত একটি বিএনপি। যারা নির্বাচনে অংশ নেবে। আর সেটা সম্ভব হলে সরকার যা চাইছে, তাই হবে। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার এ মামলা সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ ন্যায়বিচারের প্রকাশ হিসেবে দেখছে না। তারা মনে করে, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ও শেয়ারবাজার থেকে লুটপাট হলেও তার কোনো বিচার হচ্ছে না। অথচ দেড়-দুই কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ আনা হচ্ছে, যা ব্যবহারই করা হয়নি।

প্রফেসর আসিফ নজরুল বলেন, দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডায় বলা হয় তিনি এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। এ ধরনের কথাবার্তা জনগণ রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবেই দেখছে। তিনি বলেন, আগামীতে নির্বাচন হবে কি হবে না সেই শঙ্কার চেয়ে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না সেটাই মূল প্রশ্ন। বেগম খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন মামলায় সাজা ও ব্যস্ত রাখা গেলে নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে সর্বশক্তি নিয়োগ করা সম্ভব হবে না। তিনি উচ্চ আদালতে জামিন পেলেও মুক্ত স্বাধীনভাবে নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ পাবেন বলে মনে হয় না। তবে নি¤œ আদালতে বেগম খালেদা জিয়ার বিচার কতটুকু সঠিক হয়েছে, আপিলের শুনানিকালে যুক্তিতর্কে তা বুঝা যাবে। কেননা এ ধরনের ঘটনায় প্রায়ই দেখা যায়, উচ্চ আদালতে মামলার রায় উল্টে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *