কিন্তু তাদের মধ্যে যে সংঘাত তা নারীসুলভ কিছু নয়।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ঘোর বিরোধী বিএনপির খালেদা জিয়ার মধ্যে ভয়াবহ শত্রুতা দেশকে সহিংসতার সর্পিল পথে টেনে নিয়ে গেছে। বাসে বোমা মারা, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিরক্তিকরভাবে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে ঘটনা সব সময় এমন ছিল না। তারা (হাসিনা-খালেদা) ১৯৮০ দশকে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল (অব.) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে উৎখাত করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রকৃতপক্ষেই একসঙ্গে কাজ করেছেন। দু’নারীই রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী। তিক্ত এক যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তানের কাছ থেকে। ওই স্বাধীনতা যুদ্ধে শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিদের উত্তরাধিকারী তারা।
বাংলাদেশি রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষককে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যখন প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থীরা সরে গেলেন তখন অন্য প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি?
আমার প্রশ্ন শুনে তিনি বড় করে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, অবশ্যই তারা করেছিল। তারা শুধু মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিল। অথবা তাদের দিয়ে সেটা করানো হয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন প্রভাবিত হওয়া ক্যারেক্টার অনেক।
গত নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর শেখ হাসিনা তার বিরোধী পক্ষ বিএনপির নেতাকর্মীদের পিছু নেন। তিনি তাদের জোটের অংশীদার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেন।
এর ওপর আগামী ডিসেম্বরে নতুন আরেকটি নির্বাচন। তার আগে এ সপ্তাহে খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের জন্য জেল দেয়া হয়েছে। এতে খালেদা জিয়াকে ওই নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার চেষ্টা হতে পারে। আর তা হলে শেখ হাসিনা চতুর্থ দফায় বড় বিজয় পাবেন। এর কারণ, বাংলাদেশের আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে যদি দুই বছরের বেশি সাজা দেয়া হয় তাহলে তিনি রাজনৈতিক কোনো পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন খালেদা জিয়া। ফলে আদালত যদি রায়ে স্থগিতাদেশ দেন, এবং তা যতদিন বহাল থাকবে, সে সময়ে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। শাস্তি হওয়ার আগের দিন তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের বলেছেন, ‘বিরোধী দলবিহীন ফাঁকা মাঠে কাউকে গোল দিতে দেয়া হবে না’। কিন্তু তিনি জানেন তার বিরুদ্ধে মামলার পাহাড় আছে। দুর্নীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা পর্যন্ত প্রতিটি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩০টি ফৌজদারি অভিযোগ মুলতবি আছে।
খালেদা জিয়ার নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মনে করেন, খালেদা জিয়াকে ও তার দলের ক্ষতি করার উদ্দেশে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি নেতারা বলছেন, রায় দেয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপির কয়েকশ’ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার ও আটক বন্ধ করতে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ ঠেকানোর মাধ্যমে সরকার মতপ্রকাশের অধিকার ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার লঙ্ঘন করছে বলেও দাবি করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। রায়কে কেন্দ্র করে রাস্তায় নেমে আসা খালেদা জিয়ার কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে এবং লাঠিচার্জ করেছে। এক্ষেত্রে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার দাবি করে তারা উদার ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এভাবে দমন করার মাধ্যমে তাদের সেই দাবি অন্তঃসারশূন্য হয়ে গেছে।
তবে প্রকৃত সত্য হলো, দুই বেগম ও তাদের মধ্যকার সীমাহীন লড়াইয়ে ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন অনেক বাংলাদেশি।
আপনি যদি বাংলাদেশের রাস্তায় কোনো ক্যাফেতে রাজনীতি নিয়ে কথা বলা শুরু করেন তাহলে আপনি সব সময়ই একই রকম কণ্ঠ শুনতে পাবেন। একই রকম মত পাবেন। বাংলাদেশিরা মনে করছেন এই ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে তারা শেষ হয়ে যাচ্ছেন। এই ব্যক্তিগত শত্রুতাই এখন রাজনীতিতে বড় ঘটনা। এতেও বাংলাদেশের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে আছেন এই দু’নারী। তারা থামবেন না, যদিও তাদের বয়স এখন ৭০ উত্তীর্ণ। কিন্তু কেউই সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নন।
বৃহস্পতিবার তিনি আদালত ছেড়ে যাওয়ার সময় ক্রন্দনরত আত্মীয়-স্বজন ও নেতাকর্মীদের বলেছেন- আমি ফিরে আসবো। কান্না করো না।
(জাস্টিন রাউলাত, বিবিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক করেসপন্ডেন্ট। অনলাইন বিবিসিতে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ )