দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন না পেলেও সরকারি নির্দেশে তাঁকে ডিভিশনের সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। আর পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের যে প্রশাসনিক ভবনে তাঁকে আপাতত রাখা হয়েছে, সেটিকে সাবজেল বা বিশেষ কারাগার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে কারাগারে প্রথম দিন স্বাভাবিকভাবেই কাটিয়েছেন খালেদা জিয়া। গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে গতকাল শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে কয়েদির পোশাক পরানো হয়েছে। তিনি কারাগারের দেওয়া খাবারই খেয়েছেন। বিশ্রামের পাশাপাশি তিনি নামাজ পড়েছেন।
এর মধ্যে গতকাল বিকেলে প্রথমবারের মতো খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর ভাই-বোনসহ পরিবারের সদস্যরা দেখা করে। তারা তাঁর জন্য কাপড়চোপড় নিয়ে যায়।
এ ছাড়া বিএনপির নেতাকর্মীরাও কিছুক্ষণ পর পর কারাগারের সামনে ভিড় করে। কেউ কেউ খাবারও নিয়ে আসে। তবে পুলিশের ব্যারিকেডের কাছেই তাদের আটকে দেওয়া হয়। খাবারও ভেতরে পাঠানোর অনুমোদন মেলেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারা কর্মকর্তা জানান, খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় কয়েদির মর্যাদায় রয়েছেন কারাগারে। এ কারণে কারাবিধি অনুযায়ী তাঁকে মহিলা কয়েদির পোশাক পরতে হবে।
খালেদা জিয়া এরই মধ্যে কয়েদির পোশাক পরেছেন কি না, জানতে চাইলে ওই কারা কর্মকর্তা পরোক্ষভাবে বলেন, ‘কয়েদির পোশাক পরা ছাড়া অন্য পোশাক পরার সুযোগ নেই।’
খালেদা জিয়াকে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখায় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে গতকালও জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কারা ফটকের দেড়-দুই শ গজ দূরে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পুলিশ ও র্যাবের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
স্বজনদের সাক্ষাৎ : গতকাল বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটের দিকে একটি গাড়িতে করে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাঁর বোন সেলিনা ইসলাম, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, শামীমের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা ও ছেলে অভিক এস্কান্দার। তাঁদের গাড়িটি প্রথমে ব্যারিকেডের কাছে আসার পর পুলিশ আটকে দেয়। পরে কারাগার থেকে এক কর্মকর্তা বেরিয়ে এসে তাঁদের যাওয়ার অনুমতি দিলে পৌনে ৪টার দিকে পুলিশ ব্যারিকেড সরিয়ে দেয়। গাড়ি নিয়ে তাঁরা কারাগারের প্রধান ফটকের দিকে যান। তাঁদের যাচাই-বাচাই করে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে কারাগারে ঢুকতে দেওয়া হয়।
বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে ওই স্বজনরা আবার কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। তাঁরা গাড়িতে করে চকবাজারের দিক দিয়ে চলে যান। এ কারণে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁদের কী কথা হয়েছে, তা জানা যায়নি।
খালেদার সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই স্বজনরা গতকাল সকালে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
যেসব সুবিধা পাচ্ছেন খালেদা : কারা সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে রাখার জন্য প্রথমে পুরনো কারাগারের মহিলা ওয়ার্ডটি প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে সিনিয়র জেল সুপারের কক্ষে রাখা হয়। সেখানে থাকা চেয়ার-টেবিল সরিয়ে একটি খাট পাতা হয়েছে তাঁর জন্য। রয়েছে সোফা, এয়ার কন্ডিশনার, টেলিভিশন। সেগুলো খালেদা জিয়া ব্যবহার করতে পারছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারা কর্মকর্তা বলেন, ‘অফিশিয়ালি তিনি (খালেদা) ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি নন। ফলে তাঁকে খাট দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে তিনি বয়স্ক ও অসুস্থ একজন মানুষ। এ বিবেচনায় তাঁর বিশ্রামের জন্য সিনিয়র জেল সুপারের পরিত্যক্ত কক্ষটিতে একটি খাট পেতে দেওয়া হয়েছে। তাঁর সেবার জন্য কারাগার থেকেই মহিলা কারারক্ষী দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিগগিরই মহিলা কারাগার থেকে সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন মহিলাকে আনা হবে তাঁর সেবা করার জন্য। কারাবিধি অনুযায়ী এমন সুযোগ দেওয়ার বিধান রয়েছে।’
খালেদা জিয়ার জন্য পুরনো কারাগারটিতেই রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান ওই কারা কর্মকর্তা।
খালেদা জিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উনাকে (খালেদা) কোথায় রাখা হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সেটা জানাব না। এত বড় কারাগারে মাত্র একজন বন্দি। তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করতে হয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে জেল সুপার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত (গতকাল বিকেল ৫টা) আমরা আদালত বা সরকারের তরফ থেকে তাঁকে (খালেদা) ডিভিশন দেওয়ার নির্দেশ পাইনি। যতক্ষণ ডিভিশন দেওয়ার নির্দেশ না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন দেওয়ার সুযোগ নেই।’
তবে এক কারা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় কারাবিধি অনুযায়ী হাজতি থাকাকালে (সাজা হওয়ার আগ পর্যন্ত) তিনি ডিভিশন পাবেন। কিন্তু কয়েদি হলে (সাজা হওয়ার দিন থেকে) সেই সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। তবে আদালত ও সরকার নির্দেশ দিলে ডিভিশন দেওয়া যায় বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
খালেদা জিয়ার সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে চাইলে এক কারা কর্মকর্তা বলেন, খালেদাকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে আগে টেলিভিশন না থাকলেও একটি টেলিভিশনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন সাধারণ বন্দিরাও কারাগারে টেলিভিশন দেখার সুযোগ পেয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
খালেদা তাঁর সঙ্গে নিজস্ব গৃহকর্মী রাখার যে আবেদন করেছেন সে ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই কারা কর্মকর্তা বলেন, ‘আদালতের আদেশ আমরা এখনো হাতে পাইনি। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আছে তাঁর গৃহকর্মী ফাতেমা।
এর আগে বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর কারা চিকিৎসক তাঁর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর রক্তচাপ (ব্লাড প্রেসার) স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানা গেছে।
কারা সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া বৃহস্পতিবার বিকেলে কারাগারে ঢোকার পর তাঁকে গ্রহণ করেন কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে সিনিয়র জেল সুপারের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখানে তিনি বিশ্রাম নেন। পরে তাঁকে চা-বিস্কুট খেতে দেওয়া হয়। রাতে মাছ ও সবজি দিয়ে ভাত দেওয়া হয় তাঁকে।
আর গতকাল সকালে কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়া রুটি-সবজি দিয়ে নাশতা করেছেন খালেদা জিয়া। দুপুরে কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়া মাছ ও ভাত খেয়েছেন তিনি।
কারাগারের সামনে ভিড় করছে নেতাকর্মী : গতকাল বিকেলে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, খালেদা জিয়ার জন্য নানা ধরনের ফল নিয়ে এসেছে তাঁর দলের নেতাকর্মী। তবে কাউকে কারাগারের ফটকের সামনেই যেতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের ব্যারিকেডের পাশেই তাদের আটকে দেওয়া হয়। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে একটি ডালায় করে ফল নিয়ে আসেন বিএনপির দুই নেত্রী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. আরিফা জেসমিন নাহিন ও অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম রেখা। তাঁরা কারাগারের সামনে যেতে চাইলে পুলিশ আটকে দেয়।
আরিফা জেসমিন বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য এসেছি। কিছু ফল নিয়ে এসেছি, যদি সেগুলো পৌঁছানো যায় ম্যাডামের কাছে।’