দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার প্রেক্ষাপটে হঠাৎ গ্রেফতার অভিযানে বিএনপির শীর্ষ ও মাঠপর্যায়ের নেতারা ভেঙে পড়েননি। বরং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দলীয় প্রধানের সাজা হলে চলমান বৈরী পরিস্থিতি সামলে চূড়ান্ত আন্দোলনের পথে যাওয়ারই প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
এ দিকে মামলার রায়, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আজ শনিবার দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রথম সভা আহ্বান করেছে বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে দিন ব্যাপী এই সভায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলার সভাপতি এবং আমন্ত্রিত নেতারা উপস্থিত থাকবেন। সকাল থেকে নেতাকর্মীদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামত নেবেন তিনি। বিকেলের দিকে সমাপনী বক্তব্যে দিকনির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবেন খালেদা জিয়া। উপস্থিত নেতাকর্মীদের মাধ্যমে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিতে চান তিনি।
মূলত আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্যই নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিতে যাচ্ছেন বিএনপির চেয়ারপারসন। বিশেষ করে তার অনুপস্থিতিতে নেতাকর্মীরা যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন সে বিষয়টিতেই জোর দিয়ে আগামী দিনগুলোতে বিএনপির রাজনীতির কথা ব্যাখ্যা করবেন তিনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায় দেয়ার পাঁচ দিন আগে আজকের নির্বাহী কমিটির এই সভাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বেগম জিয়ার নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন।
নির্বাহী কমিটির সভার প্রস্তুতি প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক থেকেই দলের নেতাকর্মী এবং দেশবাসীর উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবেন খালেদা জিয়া। নির্বাচনের এই বছরে চলমান রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমাদের দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির এই সভা হচ্ছে। সভাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই সভা থেকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশবাসীর উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবেন। দেশের চলমান রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে কী করণীয় সে সম্পর্কে তৃণমূলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামত শুনবেন চেয়ারপারসন।
জানা গেছে, আজ শনিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় পাঁচতারকা হোটেল ‘লা মেরিডিয়ান’র গ্র্যান্ড বলরুমে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা হবে। দিনব্যাপী এই সভায় সভাপতিত্ব করবেন খালেদা জিয়া। যিনি টানা ৩৩ বছর দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। নির্বাহী কমিটির সভায় দেশের চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি, একাদশ সংসদ নির্বাচন ও সাংগঠনিক কার্যক্রমসহ বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
এ দিকে বিএনপির ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটির সদস্যের পরিচয়পত্র বিতরণ গতকাল বিকেলে শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সদস্যদের পরিচয়পত্র বিতরণ শেষ হয়েছে। শোক প্রস্তাবও তৈরি হয়ে গেছে। বৈঠকের অনুষ্ঠানস্থলের সাজসজ্জার কাজও শেষ। নির্বাহী কমিটির ৫০২ সদস্যের বাইরে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য, প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা ও মহানগরের সভাপতি/আহ্বায়ক এতে উপস্থিত থাকবেন।
রিজভী বলেন, এই সভা যাতে না হয় সেজন্য দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে সরকার। এখনো গ্রেফতার অভিযান ও নেতাকর্মীদের বাসায় হানা ও তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে। তবে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভার প্রস্তুতি সম্পন্ন। এই সভায় সাংগঠনিক ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরে আলোচনা হবে। এসব বিষয়ে নেতাকর্মীদের মতামত শুনে সবশেষে আমাদের চেয়ারপারসন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেবেন। তার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যের অপেক্ষায় রয়েছি আমরা সবাই।
এ দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে নির্বাহী কমিটির সভা সরাসরি সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। নির্বাহী কমিটির সভা ও দেশবাসীর উদ্দেশে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাষণ লাইভ দেখা যাবে। বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, Facebook.com/bnp.communication, facebook.com/bnpbd.org এবং faceboo.com/bnplivenettv অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার হবে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ তাদের দলের চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে দেয়া রায়কে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি ক্র্যাক
ডাউন করেছে। বিরোধী দলকে দুর্বল করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াই সরকারি দলের মূল টার্গেট।
বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ বলেন, বিএনপিকে ঘিরে ফেলার পথ খুঁজে বের করার জন্য সরকার একটি ফাঁদ তৈরি করেছে। দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে বিএনপিকে দোষারোপ করা হচ্ছে এবং একতরফা নির্বাচনের পর আবারো দলটিকে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু এই সরকারকে আমরা সেই সুযোগ আর দেবো না।
নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা: আনোয়ারুল হক বলেন, সরকার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে আবারো একদলীয় নির্বাচন করতে চাইছে। কিন্তু তাদের সেই সাধ পূরণ হবে না।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান বলেন, আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাই এবং এই সময় আমরা চ্যালেঞ্জ ছাড়াই রাজপথ ছেড়ে যাবো না। অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ছাড়া আমরা ঘরে ফিরব না। আর আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হলে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলব।
বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দলীয় প্রধানের দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেও দলটি স্বাভাবিকভাবেই চলবে। ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দিনের সময় একটি সাংগঠনিক সঙ্কট ছিল। কিন্তু এই সময়, এই ধরনের কোনো সঙ্কট হবে না। সব নেতা এখন ঐক্যবদ্ধ। ইতোমধ্যে খালেদা জিয়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, যুগ্ম মহাসচিব ও ২০ দলীয় জোটের সাথে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, এর আগেও তিনি জেলে গিয়েছেন। তাই এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝে কর্মসূচি ঘোষণা করার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দেন খালেদা জিয়া। অতীতের মতো দুঃসময়ে খালেদা জিয়ার পাশে থাকার আশ্বাস দেন বৈঠকে অংশ নেয়া জোটের শীর্ষ নেতারা। এ ছাড়া খালেদা জিয়াকে ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন তারা। ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণাকে সামনে রেখে সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সাথেও বৈঠক করেছে বিএনপি। এ সময় বহু দেশের কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা রায় ও দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস শেষে ৫০২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণার পর এই প্রথম জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি ছয় মাস অন্তর জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠানের বিধান থাকলেও প্রায় দুই বছর পর এই সভা করছে বিএনপি।