আর বিএনপির নেতারা বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি আইসিটি আইনের চেয়েও ভয়ংকর।
আইনটি নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
গত সোমবার মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়। এর মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করলেও নতুন আইনে ৫৭ ধারার বিষয়বস্তুগুলো চারটি ধারায় ভাগ করে রাখা হয়েছে। এ জন্য আলাদা আলাদা শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে। আইসিটি আইনে ৫৭ ধারায় মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো-সংক্রান্ত বিষয়গুলো একত্রে ছিল।
নতুন আইনের ৩২ ধারা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি উঠেছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে।
বিএনপির নেতারা যা বললেন
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া আইসিটি আইনের চেয়েও ভয়ংকর। কেননা, যে যে কাজের কারণে ৫৭ ধারায় অভিযুক্ত করা যেত, সেসব কাজকে এই আইনে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হলে দেশে মানুষের বাক্স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে কিছুই থাকবে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই আইনটি আরও একটি ‘কালো আইন’ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
মন্ত্রীরা যা বললেন
প্রস্তাবিত ওই আইন নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে পৃথকভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আর সচিবালয়ে নবম সংবাদপত্র মজুরি বোর্ড গঠনের তথ্য জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল ইনুর কাছে প্রশ্ন রাখলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আইনটি সঠিক ও স্বচ্ছতার সঙ্গেই করা হয়েছে। সত্য রিপোর্ট প্রকাশ করলে বোঝা যাবে। যদি প্রতিবেদন সত্য হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি মনে করেন না।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পত্রপত্রিকায় সাংসদদের নামে চরিত্র উদ্ঘাটন করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অনেকে তথ্য সরবরাহ করার চেষ্টা করে, যেগুলো সঠিক নয়। এগুলো সাংবাদিকদের বিবেচ্য বিষয়।
এই আইন সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় বাধা হবে না বলে মনে করেন তোফায়েল আহমেদ। আইন করেও সাংবাদিকদের থামানো যাবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। বিএনপি সরকারের সময় প্রণীত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাকে নতুন আইনে স্পষ্ট করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তোফায়েল আহমেদ।
‘অহেতুক ভীতি’
নিজ দপ্তরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, গুপ্তচরবৃত্তি তো আগেও আইনে অপরাধ ছিল। এ আইনের মধ্যে যেটা করা হয়েছে সেটা হলো, কম্পিউটার সিস্টেম বা ইনফরমেশন টেকনোলজির সিস্টেমের মাধ্যমে যদি কেউ গুপ্তচরবৃত্তি করে, সেটা অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। এটার সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক আছে বলে তাঁর মনে হয় না। তিনি বলেন, এটা অহেতুক ভীতি।
আইনমন্ত্রী বলেন, তাঁদের বিশ্বাস এই আইনের কারণে ৫৭ ধারার যে অপপ্রয়োগ হচ্ছিল, সেটা বন্ধ হবে। এই আইনে কারও বাক্স্বাধীনতা হরণ হয়নি বলেও উল্লেখ করেন আইনমন্ত্রী।
আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা তৈরি করবে
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এক বিবৃতিতে বলেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইন ৫৭ ধারার চেয়েও বিপজ্জনক। এটি সংবিধানে স্বীকৃত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
গতকাল এক বিবৃতিতে আসক বলেছে, ৩২ ধারা সাংবাদিক, লেখকসহ তথ্য সংগ্রহের কাজে যুক্ত পেশাজীবীদের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত করবে বলে আশঙ্কা আছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্তির ঘোষণা হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় আইসিটি আইনের অনুরূপ বক্তব্য যুক্ত করা হয়েছে। এই আইন নাগরিকের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রবণতা তৈরি করবে। আসক মনে করে, আইনটি কার্যকর করার আগে এর বিভিন্ন ত্রুটি সংশোধনে রাষ্ট্রের উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া উচিত। নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে এই মানবাধিকার সংগঠন।