দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণার দিনক্ষণ নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে বিএনপি। দলটির নেতারা এ নিয়ে নানান হিসাব-নিকাশ কষছেন। মামলার রায়ে সরকারের হস্তক্ষেপ থাকতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা উদ্বিগ্ন। তবে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অন্যায় রায় দেয়া হলে রাজপথে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এরই মধ্যে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ২০-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও প্রস্তুতি সভা করছেন। এসব বৈঠকের আসল বার্তা হলো ঐক্যবদ্ধ থাকা।
আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রথম সভা আহ্বান করেছে বিএনপি। দিনব্যাপী ওই সভায় বেগম খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন। আজ মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন কূটনীতিকদের সাথে বৈঠকে বসবে বিএনপি। এই বৈঠকে মামলার রায়সহ দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কূটনীতিকদের অবহিত করা হবে। যদিও বেগম খালেদা জিয়ার রায়ে নেতিবাচক কিছু হলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তবে ৮ ফেব্রুয়ারি রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা শেষ পর্যন্ত দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকবেন। এর বাইরে কোনো কিছুই হবে না। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে এসব জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ছাড়া অন্য অভিযুক্তরা হলেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দেশনেত্রীর (খালেদা জিয়া) বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। এত দিন আমরা মামলা আইনিভাবে মোকাবেলা করেছি। কিন্তু এই মিথ্যা, বানোয়াট ও পাতানো মামলাকে কেন্দ্র করে যদি আমাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে আমরা তা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করবো। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে কোনো রায় দেয়া হলে সরকার পতন আন্দোলন শুরু হবে।
দলের স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে সাজা দিয়ে কারাগারে নিলে নেতাকর্মীরা ঘরে বসে থাকবে না। ম্যাডামকে কারাগারে নেয়া হলে আমরা কি তখন কান্নাকাটি করবো? ঘরে বসে থাকবো? না, খালেদার মুক্তির আগেই সরকারের পতন ঘটাবো।
মামলার রায় প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নজিরবিহীন তাড়াহুড়ার মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার এই মামলা শেষ করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কোনো দিন পরাজিত হবেন না, তাকে কোনোমতেই পরাজিত করা যাবে না।
দলীয় সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার সম্ভাব্য রায় বিএনপির হাইকমান্ড গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিএনপি প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজপথে নামার। মামলার রায় নিয়ে গত শনিবার রাতে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সাথে বৈঠক করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। পরদিন রোববার ২০-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠকে রায় নিয়ে জোটগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোমতেই রায়ের আগে কর্মসূচি দেবে না বিএনপি। এ ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সক্রিয় থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে রায়ের দিনক্ষণ নির্ধারণের পর ঢাকায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা একাধিকবার বৈঠক করেছেন। গতকাল সোমবার মহিলা দল, শ্রমিক দলসহ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের নেতারা পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন শিগগিরই প্রস্তুতি সভা করবে। ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে নেতাকর্মীদের বিপুল সমাগমের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে বিপুল নেতাকর্মীকে ঢাকায় আসার মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রায়-পরবর্তী পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ইতোমধ্যে তৃণমূলে বার্তা পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত একাধিক টিম তৃণমূল সফরে গিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।
রায়ের দিন দেশের সব নেতাকর্মীকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যায়ভাবে কোনো রায় দেয়া হলে কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা যাবে তা যেন একযোগে পালন করা হয়। এ ব্যাপারে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। রায়ের দিন সারা দেশে শান্তিপূর্ণ ব্যাপক গণজমায়েত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে রায়কে কেন্দ্র করে জ্বালাও পোড়াও বা ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচিতে যাবে না দলটি। আর রায় না দেখে কঠোর কোনো কর্মসূচি দেয়া হবে না। রায় নিয়ে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি থাকবে। ইতোমধ্যে সিনিয়র আইনজীবীরা এ সংক্রান্ত প্রাথমিক কাজ শেষ করেছেন।
আজ কূটনৈতিকদের সাথে বৈঠক : এ দিকে আজ বিকেলে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসবে বিএনপি। বিকেল ৪টায় গুলশানে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই বৈঠক হওয়ার কথা। বৈঠকে বিএনপির কূটনীতিক উইংয়ের সদস্যরাও উপস্থিত থাকবেন।
শনিবার বক্তব্য রাখবেন খালেদা জিয়া : এ ছাড়া আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারের ‘রাজদর্শন’ হলে বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করা হয়েছে। ওই দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই সভা হবে। বিএনপির গঠনতন্ত্রের বিধান বলে দলের চেয়ারপারসনের পরামর্শক্রমে মহাসচিব জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা আহবান করেছেন এবং তিনি কমিটির সদস্যদের নোটিশ দিয়েছেন। এই সভায় দেশের চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, দলের সাংগঠনিক অবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হবে।
ইস্যুকৃত চিঠিতে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যদেরকে। এছাড়া নির্বাহী কমিটির সকল সদস্য, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, থানা/উপজেলা বা পৌরসভার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদেরকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। সভায় যোগদানের জন্য আগামী বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার নয়াপল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্টদের পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকার বিএনপি তথা খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে ফের একদলীয় নির্বাচনের ফর্মুলা নিয়ে এগোচ্ছে। সেজন্যই এখন একটি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানকে মাইনাস করে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না। বিএনপিকে মাইনাস করে এ দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। রায় ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা রায় দেখে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেবো। নেতাকর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় থাকার আহ্বান জানান তিনি।