ঢাকা: আড়াই মাস ধরে প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য। ফলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মামলা ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক শিগগিরই নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের আভাস দিয়েছেন।
নতুন প্রধান বিচারপতি পদে যাঁদের নাম আলোচনায় আছে, তাঁদের দুজন হলেন দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা এবং দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তাঁদের অবসরে যাওয়ার সময়সীমা যথাক্রমে এ বছরের ১০ নভেম্বর ও ৩০ নভেম্বর ২০২১।
গত সোমবার আইনমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, শিগগিরই নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সম্ভাবনা নাকচ করছেন না-এ কথায় আইনমন্ত্রীর জবাব ছিল, ‘আমি এই ধারণা কেন নাকচ করব, সম্ভাবনা তো আছে।’ তবে কে এবং ঠিক কখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পাবেন, জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণ করা হবে কি না, সেসব প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘এসব রাষ্ট্রপতির ওপর নির্ভরশীল, আমার কোনো মন্তব্য নেই।’
ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় নিয়ে সৃষ্ট টানাপোড়েনের ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত নভেম্বরে পদত্যাগ করেন। প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যাওয়ার সময় থেকেই জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন। অবশ্য পদত্যাগী প্রধান বিচারপতির স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার সময়সীমা ছিল ৩১ জানুয়ারি।
মামলার পাহাড়
অনুসন্ধানে জানা যায়, আপিল বিভাগে নতুন মামলা আসার সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে গেছে, যা আগে দেখা যায়নি। এ মুহূর্তে আপিল বিভাগের বিচারকদের মাথাপিছু মামলার হার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর মোট বিচারাধীন মামলা ছিল ১৬ হাজার ৫৬৫টি। বিচারক ও মামলার অনুপাত দাঁড়িয়েছে প্রতি একজন বিচারপতির জন্য ৩ হাজার ৩১৩টি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিশ্চিত করেন, গত বৃহস্পতিবার শুনানিকালে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা আপিল বিভাগে একটিমাত্র বেঞ্চ থাকার কারণে আরও নতুন মামলা কার্যতালিকাভুক্ত করতে অনীহা প্রকাশ করেন।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে আপিল বিভাগে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার ৫৯৩টি নতুন মামলা এসেছিল। অথচ গত তিন বছরে মামলা এসেছে গড়ে ৯ হাজার ৮১২টি (মামলা বৃদ্ধির হার ৭৫.৪৩)। আর ২০১৫ সালে ৮ হাজার ৭টি এবং ২০১৬ সালে ৯ হাজার ৯৪৫টি নতুন মামলা আসার পর গত বছর তা এক লাফে ১১ হাজার ৪৮৪টিতে উন্নীত হয়েছে। আবার গত তিন বছরের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৫ সালের (৯ হাজার ৯৯২ মামলা) চেয়ে ২০১৬ সালে ৩৫৮টি মামলা কম নিষ্পত্তি হয়েছে। আবার ২০১৬ সালের (৯ হাজার ৬৩৪ মামলা) চেয়ে ২০১৭ সালে (৮ হাজার ৫৯১) ১ হাজার ৪৩টি মামলা কম নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর মামলা নিষ্পত্তির হার খুব বেশি বেড়ে যায়। তবে এর যথার্থতা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে ভিন্নমত ছিল। ২০১৪ সালে আপিল বিভাগ ৫ হাজার ৯১১টি মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন। এক বছরের ব্যবধানে মামলা নিষ্পত্তির হার প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।
এখন মাত্র পাঁচজনের আপিল বিভাগ। ২০০২ সালের পর যা কখনো দেখা যায়নি। ২০০৯ সালের রাষ্ট্রপতির এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আপিল বিভাগের বিচারক থাকবেন ১১ জন। গত নভেম্বরে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত দুটি বেঞ্চ কাজ করছিলেন। অন্যদিকে বিচারপতি সিনহার সময় হাইকোর্টে দুই বছরের বেশি সময় বিচারক নিয়োগ বন্ধ থাকে। হাইকোর্টে বিচারকের সংখ্যা ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৯০ থেকে ১০১-এ ওঠানামা করেছে। ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫০টি মামলা বিচারাধীন থাকা হাইকোর্টে বর্তমানে এটা ৮২-তে নেমে এসেছে। গত রোববার এক দিনেই আপিল বিভাগের একমাত্র বেঞ্চে ৭৯৫টি পিটিশন তালিকাভুক্ত ছিল। যদিও অ্যাটর্নি জেনারেল মনে করেন, বিচারকস্বল্পতা নয়, গুণগত মানের দিকেই মূল নজর দিতে হবে।
গত নভেম্বরে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের পর আপিল বিভাগকে শুধু একটি বেঞ্চ দিয়ে মামলা সুরাহা করতে হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি না থাকার কারণে আপিল বিভাগে নতুন বিচারক নিয়োগের সিদ্ধান্তও আটকে আছে। কারণ, প্রধান বিচারপতি শপথ না পড়ালে নতুন বিচারকেরা কাজ করতে পারবেন না। এই পটভূমিতে শিগগিরই প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যদিও আইনমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি চাইলে এক বছরও অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
গত ডিসেম্বরে বিচারক সম্মেলনে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি উভয় বিভাগে বিচারক বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।