চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের কাছে একটা চিঠি আসে। হাবিবুর রহমান চিঠি পড়েই হতবাক। চিঠিটি এসেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস থেকে। সংগঠন থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয় চিঠিতে। এমন চিঠি পেয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হাবিবুর রহমান পুলিশকে বিষয়টি জানান। পুলিশ বেশ কিছুদিন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ওই সময়ে চাঁদাবাজদের আর কোনো তত্পরতা দেখা যায়নি। ঘটনাটি ২০১৬ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহের। পুলিশ হাবিবুর রহমানকে আশ্বস্ত করে, এ নিয়ে টেনশন করার কিছু নেই।
আগস্টের ৪ তারিখ হাবিবুর রহমানের ভাগ্নি দশম শ্রেণির ছাত্রী শামীমা তাদের বাসায় বেড়াতে আসে। যাওয়ার সময় হাবিবুরের দুই মেয়েকে পাশেই তাদের বাসায় নিয়ে যায়। তাদের একজনের বয়স ৫, আরেকজনের ৩। শামীমা ওদের খুব আদর করে। বাসায় নিয়ে খেলাধুলা করে। পরদিন সকালে শামীমার মা বাইরে কাজে যান। বাসায় থাকে শামীমা আর তার দুই কাজের মেয়ে। দুপুরে বাইরে থেকে ফিরে আসেন শামীমার মা। ঘরে ঢুকেই আতঙ্কে চিত্কার দেন। অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে শামীমা। তাকে মাথায় পানি দেওয়া হয়। জ্ঞান ফিরে আসে। ওই ঘরে পড়েছিল একটি চিঠি। আইএসের পতাকা আঁকানো। তাতে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। শামীমা তার মাকে বলে, বাসায় দুই লোক এসে মামাতো বোন রিয়া মনিকে নিয়ে গেছে। শামীমার মা তখন আরেক মেয়েকে খোঁজ করেন। বাথরুম থেকে একজনকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ছোটটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খবর পাঠানো হয় হাবিবুর রহমানকে। তিনি তার ছোট মেয়ে রিয়া মনির নিখোঁজের খবর শুনে ছুটে আসেন। তার মাথায় তখন আইএসের বিষয়টা কাজ করে। পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ বাথরুমে আটকে থাকা হাবিবুরের বড় মেয়েকে প্রশ্ন করে। কেন বাথরুমে ছিল সে। তখন বলে, শামীমা আপু আটকে রেখে লুকোচুরি খেলছিল। পুলিশের সন্দেহ শামীমার দিকে। তাকে জেরা করে পুলিশ। পুলিশ যা জানল তার কাছ থেকে, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ। পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসে। খুনি ধরা পড়ে।
পুলিশি তদন্তে জানা যায়, প্রতিশোধের স্পৃহায় সাড়ে তিন বছরের শিশু মামাতো বোনকে খুন করে দশম শ্রেণির ছাত্রী শামীমা আক্তার। নিজেকে আড়াল করতে জঙ্গি সংগঠন আইএসের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টাও করেছিল সে। শুধু তাই নয়, ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছিল দীর্ঘদিনের দুই বন্ধুকে। শেষ পর্যন্ত পুলিশি জেরার মুখে স্বীকার করে, টাকা চুরির দায়ে মামির ভর্ত্সনার জবাব দিতেই গলা টিপে তিন বছরের মামাতো বোনকে হত্যা করেছে সে। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে অকপটে পুরো ঘটনা বর্ণনাও করে মেয়েটি।
জবানবন্দির বরাত দিয়ে ইপিজেড থানার ওসি জানান, ইপিজেড থানার আলিশাহ কবরস্থান গলির ভাড়াটিয়া হাবিবুর রহমানের দুই মেয়ের মধ্যে ছোট রিয়া মনি। তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল হাবিবুর রহমানের ভাগ্নি গার্মেন্ট কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শামীমা আক্তার। সেই সময় কিছু টাকা চুরি গেলে তার মামি শামীমাকেই লাঞ্ছিত করেন। এরপর থেকে মামিকে জবাব দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল শামীমা। শামীমা টিভিতে ভারতীয় সিরিয়ালগুলো দেখে থাকে। কীভাবে খুন করতে হয় তা দেখে রপ্ত করে নিজেকে। এসব দেখে নিজেই মামির ওপর প্রতিশোধ নিতে সিদ্ধান্ত নেয় তার ছোট মামাতো বোন সাড়ে তিন বছর বয়সী রিয়া মনিকে খুন করবে। সে অনুযায়ী ঘটনার তিন দিন আগে একটি চিঠি লেখে মামার উদ্দেশে। চিঠিতে লেখা ছিল, আমরা আইএসের সদস্য। ৫ লাখ টাকা জোগাড় করে রাখ। কখন কোথায় টাকা পৌঁছে দিতে হবে আমরা বলব। পুলিশ আর র্যাবকে জানালে পরিণাম খারাপ হবে। জয় আইএসের জয়। এরপর আইএসের পতাকাটিও এঁকে দেয়। পরদিন সকালে মামিকে অনুরোধ করে দুই মামাতো বোনকে নিজেদের বাসায় এনে রাখে শামীমা। সকালে তার মা তার ছোট বোনকে স্কুলে দিতে বের হয়ে গেলে সুযোগটা লুফে নেয় সে। পাঁচ বছর বয়সী মামাতো বোন বড়টাকে বাথরুমে আটকে রেখে রিয়া মনিকে বালিশচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারপর তাকে একটি পলিথিন ব্যাগে ভরে ড্রামভর্তি পানিতে চুবিয়ে রাখে। ওপরে একটি বালতি বসিয়ে দেয়। এরপর আগে থেকে লেখা চিঠিটা তার মা এসেই যাতে দেখতে পায় সে জন্য টেবিলের ওপর রাখে। নিজের হাত-পা-মুখ ওড়না দিয়ে বেঁধে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে। তার মা এসে মেয়ের এ অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন। মুক্ত করার পর শামীমা তার মাকে বলে, সে রান্নাঘরে ভাত রান্না করছিল। এ সময় দরজায় টোকা শুনে খুলে দিতেই একজন জোরপূর্বক ঘরে ঢুকে তার মাথায় আঘাত করলে সে অচেতন হয়ে পড়ে। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার। এদিকে রিয়া নিখোঁজের খবর শুনে তার মা-বাবা বিষয়টি ইপিজেড থানাকে জানান। ওসিসহ অন্য কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। এরই মধ্যে বাথরুমে আটকে রাখা মামাতো বোনটিকে বের করা হয়। ওসি শামীমার সঙ্গে কথা বলেন। পরে মামাতো বোনের সঙ্গে কথা বললে সে জানায় আপুই তাকে লুকোচুরি খেলার কথা বলে। সে বাথরুমে লুকিয়ে থাকতে ঢুকলে বন্ধ করে দেয় দরজা। নিয়ে আসা হয় শামীমাকে বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে। টানা সাত ঘণ্টা জেরা করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করতে থাকে শামীমা। এ সময় সে বলে, আইএস জঙ্গিরা বাসায় এসে তাকে জিম্মি করে রিয়াকে নিয়ে গেছে। আবার বলে, তার প্রেমিক এবং আরেক বন্ধু এসে মুক্তিপণের জন্য রিয়াকে নিয়ে গেছে। পরে রাত দেড়টার দিকে সে স্বীকার করে আইএস বা অন্য কিছু নয়, রিয়াকে সে-ই খুন করেছে মামির ওপর প্রতিশোধ নিতে। তার তথ্যানুযায়ী ড্রামের ভিতর থেকে রিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় রিয়ার বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেফতার করা হয় শামীমাকে। সে এখন জেলহাজতে।