কেরানীগঞ্জের নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার বন্দীকে সেবা দেয়ার নামে চলছে ‘ফ্রি স্টাইলে’ অনিয়ম আর দুর্নীতি। একজন বন্দীকে কারাগারে আরামে থাকতে হলে অবশ্যই তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা গুনতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে কারা হাসপাতালে কোনো বন্দী থাকতে চাইলে তাকে শুধু ডাক্তারের জন্যই ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। এর বাইরে ওয়ার্ডের আলাদা চার্জতো আছেই। নিত্যদিনের খাবার ও কারাক্যান্টিন থেকে অতিরিক্ত খাবারের টাকা এ খরচের বাইরে। শুধু থাকা, খাওয়ায় অনিয়ম হচ্ছে তা কিন্তু নয়, প্রতিদিন কমিশনের বিনিময়ে বন্দীদের কাছে স্বজনদের পাঠানো নগদ টাকা নানা কৌশলে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গতকাল কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় দিনভর সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে কারারক্ষী বন্দীর স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায় এসব তথ্য। যদিও কারাগারের মূল গেট, বাইরের কারা ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন স্থানে ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতি মুক্ত’ উল্লেখ করে সাইন বোর্ড সাঁটানো রয়েছে। এ সাইন বোর্ড দেখে বন্দী ও তাদের স্বজনরা মুচকি হাসছেন।
সরেজমিন কারাগারে খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, সাক্ষাৎ কক্ষে ফ্রি স্লিপ কেটে একেকটি গ্রুপ মোবাইল ও ব্যাগ জমা দিয়ে ভেতরে প্রবশে করছে। এভাবে বেলা ৩টা পর্যন্ত চলতে থাকে ফ্রি সাক্ষাৎপর্ব। দেখা করার পর বাইরের কারা ক্যান্টিন থেকে তারা প্রায় চড়া দামে চা-পাতা, চিনি, সিগারেট, বিড়ি, বিস্কুটসহ নানা খাবার কিনতে দেখা যায়। ওই খাবারগুলোই পরে ভ্যানগাড়িতে করে কারাগারের ভেতরে পাঠিয়ে দিতে দেখা যায়।
এ প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে কারাগারের মূল ফটকের পাশে ছোট ঘরে ডিউটিরত কারারক্ষী আনিসের সাথে কারাভ্যন্তরে বন্দীদের সুযোগ-সুবিধার কথা জানতে চাইলে তিনি অকপটে বলেন, এখানে একটা আছে সেল, আরেকটা আছে মেডিক্যাল। মেডিক্যালে যদি কেউ থাকে তাহলে তাকে প্রতি মাসে সিট পারপাস ডাক্তারকে ১০ হাজার টাকা খরচ দিতে হবে। সিটের সাথে জাজিম পাবে, তোষক পাবে। ঠিক আছে। সিটের জন্য ১০ হাজার টাকা আর ওয়ার্ডের চার্জ দিতে হবে ২ হাজার টাকা। মোট ১২ হাজার টাকা দিতে হবে প্রশাসনকে শুধু একজন বন্দীকে থাকা বাবদ। খাওয়া দাওয়া ওরটা ওর নিজের। থাকা ছাড়া ওর আলাদা খরচ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেমন ভেতরের ভাত ও খাইল না। কিনে খাবে। তাইলে ওই টাকাটা ওকে দিতে হবে। টোটাল প্যাকেজ কত? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা যার সেই জানে। কেননা ও কোন দিন কত খাবে। এটা ওর সিস্টেম। আমাদের তিন বেলা খাবারের কোনো সিস্টেম নেই। জেলখানার খাবার খাওয়া যায় না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কেন যাবে না! খাইতেছে না। যারা খাইতে পারে না, তারা কিন্যা খায়। মেডিক্যালে যারা থাকে তারা বেশি রভাগই কিন্যা খায়। যে ব্যাটা ১০ হাজার টাকা খরচ করতে পারে সেই ব্যাটা ভাত কিন্ন্যা খাইতে পারবে না? এখানে এক বেলার ভাত ৮০ টাকা কইর্যা। এক বেলা ভাত কিনলে দুই বেলা খাওয়া যায়। শুধু ভাতই। তরকারির টাকা আলাদা। একেকটার একেক হিসাব। মুরগি এক হিসাব, গরু খাইলে এক হিসাব। টাকাটা দিমু কার কাছে। ভেতরে টাকা দিলে সেটি আমার কাছেই দিয়ে যেতে পারেন। আমার হিসাব হলো, এক হাজারে ১০০ টাকা কমিশন দেবেন। যদি হয় তাহলে বিকেলের মধ্যে আমার কাছে দিয়ে যাবেন। টাকা ভেতরে পাঠাবেন কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটি আমার ব্যাপার। আমি কিভাবে ভেতরে নিয়ে যাবো?
এ ব্যাপারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি। পরে আইনপ্রয়োগকারী একজন কর্মকর্তার কাছে এসব অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরো বিষয়টির ব্যাপারে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। এর আগে শ্যামপুর থানার একটি নারী নির্যাতন মামলার আসামির ভাই তার স্ত্রীকে নিয়ে দেখা করে কারাগার থেকে বের হচ্ছিলেন। কারাগারের ভেতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, আসলে কারাগার সম্পর্কে নতুন করে আর কী বলব! টাকা ছাড়া ভেতরে কোনো কিছুই হয় না। তখন কারাগার দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার কথা জানালে তারা বলেন, এখানে আরামে থাকতে হলে টাকা লাগে, খাইতে টাকা লাগে। ভেতরে নগদ টাকা পাঠাতে চাইলে সেটিও সম্ভব। এক হাজার টাকা পাঠাতে চাইলে ২০০ টাকা কমিশন তারা কেটে রাখবে।
কোনো কোনো কারারক্ষী আবার ১০০০ টাকার বিপরীতে ১০০ টাকা কমিশন নেয়। তারপর ভেতরে ভালো খাবার খেতে হলেও প্রতি সপ্তাহের জন্য অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, আমার ভাই এখানে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আছে। শ্যামপুর থেকে আমাদের আসতে বেশি সময় লাগে না। তাই আমরা তিন দিনের জন্য ১০০০ টাকা নগদ দিয়ে যাই বাইরের কারা ক্যান্টিনে। সেখান থেকে ভেতরে ৮০০ টাকা পাঠায়। সেটি দিয়ে ভাইয়ের তিন দিন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়।
তিনি বলেন, তার জামিনের চেষ্টা করছি। এ সময় লালবাগ থেকে আসা দুই বন্ধু সাক্ষাৎ কক্ষ থেকে বের হন। তাদের সাথে বন্দীদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের একজন বলেন, আমার যে আসামি ভেতরে আছে সে হলো আল আমিন হত্যা মামলার আসামি। আর এ কারাগারতো এখন আমেরিকার কারাগারের মতো হয়ে গেছে! থাকতে কোনো কষ্ট নেই। বড় কারাগার। আমিও মাদকের একটি মামলায় দেড় মাস ছিলাম। কয়েক দিন আগে বের হলাম। সরকারি খাবারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ভেতরে সরকারিভাবে যে খাবার দেয়া হয় সেটির মান খুব খারাপ। আর ডাইল দেয় কোনটা জানেন? আমরা ভাত খাইয়্যা প্লেটে হাত ধুইলে যে কালার হয় ডাইলের কালারও দেখতে তেমনই? কোনো স্বাদ নাই। উপরন্তু ভাতে গন্ধ। তাই আরামে থাকতে হলে ভেতরে টাকা ছাড়া কিছুই হবে না।
তারা দুই বন্ধু আরো বলেন, কারাগারের ভেতরে ইয়াবা ট্যাবলেট অনায়াসে পাওয়া যায়। বড়টা ৫০০ টাকা, আর ছোটটা ৩০০ টাকা। আর কারা ক্যন্টিনের বাইরে কোনো খাবার ভেতরে যেতেও দেয়া হয় না জানিয়ে বলেন, এই সুযোগে তারা ইচ্ছামতো দাম নিচ্ছে। এ সময় এক মহিলা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কারাগারে এখন বন্দীদের সাথে জুলুম চালাচ্ছে কারারক্ষী ও তার লোকজন। তার ছেলের কাছে নগদ ৭০০ টাকা তিনি দিয়ে এসেছেন। বিনিময়ে ২০০ টাকা কমিশন দিতে হয়েছে। তাদের প্রশ্ন এসব কি কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কি দেখছেন না?