প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের এই মেয়াদের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আশা করেন, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপতি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। এই কমিশন ইতিমধ্যে দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের বেশ কিছু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করায় জনগণের আস্থা অর্জন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেন, কোনো কোনো মহল আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘জনগণ অশান্তি চান না। নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনের নামে জনগণের জানমালের ক্ষতি করবেন—এটা জনগণ মেনে নেবে না।’ তিনি সাধারণ মানুষের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ‘আপনারাই সকল ক্ষমতার মালিক। কাজেই লক্ষ্য আপনাদেরই ঠিক করতে হবে—আপনারা কী চান? আপনারা কি দেশকে সামনে এগিয়ে যাওয়া দেখতে চান, না বাংলাদেশ আবার পেছনের দিকে চলুক তাই দেখতে চান। একবার ভাবুন তো মাত্র ১০ বছর আগে দেশের অবস্থানটা কোথায় ছিল? আপনারা কি চান না আপনার সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে স্বাবলম্বী হোক? আপনারা কি চান না প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে যাক? আপনারা কি চান না প্রতিটি গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হোক? মানুষ দুবেলা পেট পুরে খেতে পাক? শান্তিতে জীবনযাপন করুক?’
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হতে চলেছে। আমরা আর দরিদ্র হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই। এসব যদি আপনাদের চাওয়া হয়, তাহলে আমরা সব সময়ই আপনাদের পাশে আছি। কেননা, আমরাই লক্ষ্য স্থির করেছি যে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করব। শুধু লক্ষ্য স্থির করেই কিন্তু আমরা বসে নেই। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করে সেগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই না; তবে অতীতকে ভুলেও যাব না। অতীতের সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে, ভুল-ত্রুটি শুধরে নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাব। আমরা উন্নয়নের যে মহাসড়কে যাত্রা শুরু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখান থেকে আর পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে সকল বাধা দূর করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। আসুন, দলমত-নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম পাবে সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলব। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’
ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বর্ষপূর্তিতে তিনি জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছেন। তিনি দল হিসেব আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করা, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে তিন দফা সরকার গঠন করে যে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, তার বিস্তারিত তুলে ধরেন। একই সঙ্গে অন্য সরকারগুলোর নানা নেতিবাচক দিক উল্লেখ করেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামাত জোট সারা দেশে নির্মম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনের দিন ৫৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হত্যা করা হয় প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। ২০১৩ থেকে ২০১৫—এই তিন বছরে বিএনপি-জামাত সন্ত্রাসীদের হাতে প্রায় ৫০০ নিরীহ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হন। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গাড়ি, ২৯টি ট্রেন ও ৯টি লঞ্চ পোড়ানো হয়। ৭০টি সরকারি অফিস ও স্থাপনা ভাঙচুর এবং ছয়টি ভূমি অফিসে আগুন দেওয়া হয়।
২৮ বছর বঞ্চিত থেকেছে মানুষ
আওয়ামী লীগের শাসনামল বাদে বাকি ২৮ বছর বাংলাদেশের জনগণ বঞ্চিত থেকেছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত ছিল। জনগণের কল্যাণে তারা কোনো ভূমিকা রাখেনি। বরং আওয়ামী লীগ সরকার জনকল্যাণে যেসব কাজ হাতে নিয়েছিল, তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুফল সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালে তাঁর সরকার গঠনের কারণেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় আছে। একটানা নয় বছর জনসেবার সুযোগ পাওয়ার কারণেই দেশ উন্নত হচ্ছে। জনগণ এর সুফল ভোগ করছেন।
বাংলাদেশ নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা পেয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ২০০৫ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার। এখন তা ১ হাজার ৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় ২২ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। ওই জিডিপর আকার ছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। বর্তমানে তা ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জিডিপির প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২-৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে মূল্যস্ফীতি কমেছে, বিনিয়োগ ও রপ্তানি বেড়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৯ বছরে ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। ১ হাজার ৪৫৮টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৩৬৫টি কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে। ৫০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। বছরের প্রথম দিন বিনা মূল্যে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
১১৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার কথা উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। শতকরা ৮৩ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন। ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হবে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কেউ বেকার এবং দরিদ্র থাকবে না বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’—জাতির পিতার এই আপ্তবাক্য তাঁর সরকারের মূল প্রতিপাদ্য। এই নীতি অনুসরণ করে প্রতিবেশীসহ সব দেশের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অত্যাচার এবং নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের সরকার আশ্রয় দিয়েছে। তাদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে এবং চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।