নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকার সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার পরও রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা আগমন বন্ধ হয়নি। গত দেড় মাসে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন আরো ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। সমুদ্র ও নদীপথে আসছেন তারা। গত বুধবার শীলখালী হয়ে শতাধিক রোহিঙ্গা ভর্তি ট্টলার উপকূলে নোঙর করে। পরে তাদের কুতুপালং ক্যাম্পে নেয়া হয়।
বাংলাদেশ সরকার যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে তখনই মিয়ানমার সরকার নতুন অজুহাত তৈরি করেছে। গত শুক্রবার রাখাইনে সেনাবাহিনীর টহলরত গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলার অজুহাত দেখিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সংকট তৈরি করেছে সুচি’র সরকার। রাখাইনে সেনা টহল জোরদার করেছে। এ পরিস্থিতিতে এপারে বিজিবিও সতর্কাবস্থায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে সদ্য আগত কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত শুক্রবার রাখাইনের মংডুর তোরাইন এলাকায় আরসা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গাড়ী বহরে কথিত হামলা চালিয়েছে। এতে একজন সেনা সদস্য নিহত ও দুই সেনা আহত হওয়ার দাবি করেছে সেনাবাহিনী। এরপর মিয়ানমার সেনারা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে আরসা সদস্যদের তল্লাশীর নামে নিরীহ রোহিঙ্গাদের মারধর, লুটপাটসহ নানা নির্যাতন শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার বাধ্য হয়ে যখন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে তখন ‘আরসা’ নামের একটি সংগঠনের নামে রাখাইনে নতুন করে হামলার ঘটনা সাজানো নাটক বলে মনে করছেন রোহিঙ্গারা। এছাড়া গত বছরের ২৪ আগস্ট রাখাইনে পুলিশ পোস্টে হামলার ঘটনাও রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করার মিয়ানমার সরকারের কৌশল বলে রোহিঙ্গারা মনে করেন। আরসা নিজেদের রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়কারী সংগঠন হিসেবে পরিচয় দিলেও রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, তারা এই সংগঠনের সদস্যদের চেনেন না। তারা মনে করেন, আরসা নামের সংগঠনটি মিয়ানমার সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি লালু বলেন, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনে পুলিশ চৌকিতে আরসার হামলার যে দাবি করা হয় তা সেনাবাহিনীরই পরিকল্পনায় হয়েছে।
তিনি বলেন, আরসা নামের সংগঠনটির কোনো সদস্যকে রাখাইনে এ পর্যন্ত কেউ দেখেছেন বলে মনে হয় না। মূলত: আরসা নামের এ সংগঠনটি মিয়ানমার সেনাবাহিনীরই সৃষ্ট। মিয়ানমার সরকার আরসার হামলার কথা বলে রাখাইনে বসবাসরত বিপুলসংখ্যক মানুষকে দেশছাড়া করতে চাইছে।
তিনি বলেন, আমরা আরসাকে বিশ্বাস করি না। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আমাদের জন্মভূমি রাখাইনে ফিরে যেতে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক বলেন, রাখাইনে আরসা নামে কোনো সংগঠন নেই। আরসা আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। এটি মিয়ানমার সরকারের সৃষ্ট। রাখাইনে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করার ষড়যন্ত্রের অংশ। আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই।
টেকনাফে লেদা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, মিয়ানমার সরকারের নাটক আমরা বুঝে গেছি। রাখাইনে এ পর্যন্ত কোনো হামলা হয়নি। আরসার অজুহাতে সরকার আমাদের দেশছাড়া করেছে। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে। মিয়ানমার চাইছে যেকোনো উপায়ে রাখাইন খালি করতে। এতে তারা অনেকটা সফল।
রাখাইনের বুচিডং ছিনতাইং গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে হাবিবুর রহমান (৪২) জানান, তারা যখন মিয়ানমারের ধনখালী ঘাটে ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখন জানতে পারেন মিয়ানমার সেনারা তাদের বাড়ি-ঘর লুটপাট করে আগুন দিয়েছে।
ওই গ্রামের মাহামুদুর রহমানের ছেলে আব্দুল গণি (৩৯) জানান, তাদের গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার যখন গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলাকীর্ন পথে এগুচ্ছিলেন তখন তারা কয়েকটি গুলির আওয়াজ শুনেছেন। পরে জানা গেছে, সেনারা সোনা মিয়া (১৮) ও শামসুল আলম (২২) নামে দুই রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করেছে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, মংডু শহরের আশে-পাশের রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক অভিবাসন কার্ড (এনভিসি) দিচ্ছে প্রশাসন। হাঁট-বাজারে যাতায়াতকারী, গ্রাম্য পথচারী ও জীবিকার সন্ধানে বের হওয়া রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে মারধর করে এনভিসি ধরিয়ে দিচ্ছে।
তারা আরো জানিয়েছেন, মংডু শহরের নিকটবর্তী মাংগালা, চার মাইল, নাগফুরা, সিকদার পাড়া, শোয়েজা প্রভৃতি এলাকার যেসব রোহিঙ্গা ঘর থেকে বের হচ্ছেন তাদের আটক করছে টহলরত যৌথবাহিনী। আটককৃতদের ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের বুথে নিয়ে টিপ সই ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশান কার্ড দিচ্ছে। এসব কার্ডে জাতীয়তা ‘বাংলাদেশী’ উল্লেখ রয়েছে।
এদিকে আগামী ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ-মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সভায় প্রত্যাবাসনের জন্য এক লাখ রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। তবে কমিটির এক সদস্য জানান, সময় মতোই তারা এক লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবেন।