কক্ষ নম্বর ৪০৮। একটি দরজা। কাচের অংশে নয়টি স্থানে ভাঙা। ওই কক্ষে আছে দুটি জানালা। এ দুটিতেও আটটি স্থানে একই রকম ভাঙা। সন্ধ্যার পর ভাঙা অংশের ফাঁক গলে হিম বাতাস ঢোকে। কক্ষে তখন থাকা দায় হয়ে পড়ে।
কক্ষের আবাসিক ছাত্র মো. মহসীন মিয়া শীতে জবুথবু। তাঁর ভাষ্য, ‘খুব ঠান্ডা পড়ছে তো, মারাত্মক ঠান্ডার কষ্ট সইয়ে আছি। না থাকলে বোঝা যাইত না কী কষ্ট!’ এ কথা বলে মহসীন তাঁর কক্ষের দরজা-জানালার ১৭টি স্থান দেখিয়ে বলেন, ‘ভাঙা দিয়া রুমে ঠান্ডা ঢোকে। ঘুম ভাঙি যায়। তাই ভাঙা অংশে কাগজ গুঁজে রাখছি।’
কাগজ গুঁজে ঠান্ডা নিবারণের এ রকম চেষ্টা গত মঙ্গলবার দেখা গেল সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে। গত বছরের ১৩ জুলাই পুনর্নির্মিত ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের একাংশ ভাঙচুর করে। এতে ছাত্রাবাসের চারটি ব্লকের ৪০টি কক্ষের দরজা-জানালার কাচ ভেঙে যায়। এর মধ্যে কম ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রাবাসের কিছু অংশ তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রাবাস কর্তৃপক্ষ সংস্কার করে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া চতুর্থ ব্লকের ১৬টি কক্ষ সংস্কার না হওয়ায় শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডার কষ্টে পড়েছেন এসব কক্ষের আবাসিক ছাত্ররা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চতুর্থ ব্লকে পাশাপাশি ১৬টি কক্ষের ১৬টি দরজা ৪৭টি জানালার কাচের অংশ ভাঙা। ঢিল ছুড়ে ভাঙায় কোনো কোনো অংশ অনেকটা ঝাঁঝরা হয়ে আছে। আবার কোনো অংশে কাচ একেবারে নেই। ভাঙা অংশগুলোতে মোটা কাগজ গুঁজে রাখা হয়েছে।
একেকটি কক্ষে দুজন করে ছাত্র আছেন। আবাসিক ছাত্ররা জানান, ঘটনার পরপরই ছাত্রাবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন ছাত্রদের ছাত্রাবাস ছাড়ার সময় কর্তৃপক্ষ সংস্কার করার জন্য বন্ধ রাখার বিষয়টি জানায়। এক সপ্তাহ পর যখন ছাত্রাবাস খুলে দেওয়া হয়, তখন কম ভাঙচুর হওয়া কক্ষ সংস্কার অবস্থায় দেখা গেছে। আর বেশি ভাঙচুর হওয়া কক্ষগুলো শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে সংস্কার করা হবে বলে জানানো হয়েছিল। দরজা-জানালার ভাঙা অংশ নিয়ে আগে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা ছিল। শীত আসার পর থেকে ভাঙা দিয়ে কক্ষে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন আবাসিক ছাত্র বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ঠান্ডা বেশি পড়ায় ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ককে প্রতিদিনই জানানো হচ্ছে। রাতে এসে ঠান্ডা অনুভব করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
ঠান্ডার কষ্টে ছাত্ররা। কিন্তু ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক জামাল উদ্দিন যেন নির্বিকার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাঙচুরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ছাত্রবাসের চার নম্বর ব্লক। ছাত্রাবাস বন্ধ থাকার সময় কলেজের ব্যবস্থাপনায় মেরামত করা হয়। তবে বাকিগুলোর সংস্কার কলেজ তহবিলের টাকা কম থাকায় সংস্কার সম্ভব হয়নি।
শীত বাড়ায় ঠান্ডার কষ্টে পড়েছে ছাত্ররা—এ বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ককে জানালে তিনি বলেন, ‘সংস্কার প্রক্রিয়াধীন থাকায় তাৎক্ষণিক কিছু করা যাচ্ছে না। এরপরও আমি বিষয়টি নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।’
ছয় মাসেও অধরা ভাঙচুর মামলার প্রধান আসামি
১৮৯২ সালে রাজা গিরিশচন্দ্র রায়ের পিতামহ মুরারিচাঁদের (এমসি) নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সিলেটসহ তৎকালীন ভারতের আসাম অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজ। সিলেট নগরের টিলাগড় এলাকায় ৬০০ শতক জায়গার ওপর ১৯২০ সালে ব্রিটিশ আমলে আসাম ঘরানার স্থাপত্যরীতির আধা-পাকা ঘরের মাধ্যমে ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জের ধরে ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়।
আলোচিত এ ঘটনার পর অবিকল আগের কাঠামোয় ছাত্রাবাস পুনর্নির্মাণের দাবি উঠলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে অবিকল কাঠামোয় ছাত্রাবাস পুনর্নির্মাণ করেন। ২০১৪ সালের ৪ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী আগের কাঠামোয় নির্মিত ছাত্রাবাস উদ্বোধন করেন। পুনর্নির্মাণের তিন বছরের মাথায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষ আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ভাঙচুর করে।
এ ঘটনায় এমসি কলেজের অধ্যক্ষ নিতাই চন্দ্র চন্দ বাদী হয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় মামলা করেন। মামলায় টিলাগড়কেন্দ্রিক বিবদমান ছাত্রলীগের একটি অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত টিটু চৌধুরীসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। এ মামলায় প্রধান আসামিকে ছয় মাসেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এ ব্যাপারে শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন বলেন, ছাত্রাবাস ভাঙচুরের মামলায় প্রধান আসামি টিটু চৌধুরী ঘটনার পর থেকে পলাতক। বাকি আসামিদের অধিকাংশ উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। তবে আসামিদের ঠিক কতজন জামিনে আছেন—এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি ওসি। তিনি বলেন, ‘প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।’