এখনই রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করতে রাজি নয় বিএনপি। সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টাই আপাতত চালিয়ে যাবে দলটি। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, রাজনৈতিক সমঝোতার সুযোগ এখনো আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা তাঁরা শেষ পর্যন্ত করে যাবেন। এতে ব্যর্থ হলে তখনই কেবল সর্বাত্মক আন্দোলনে নামবে বিএনপি।
দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনকালীন ‘সহায়ক সরকার’ বিএনপির দাবি হলেও এর রূপরেখা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সমঝোতার আশায়। ওই সহায়ক সরকারের রূপরেখার খসড়া চূড়ান্ত করা হলেও বিএনপি এখনই তা জনসমক্ষে উপস্থাপন করছে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করছে দলটি। বিশেষ করে আগে তারা সরকারের মনোভাব বুঝে নিতে চায়। বিএনপি নেতারা মনে করেন, সরকার এখন যত অনমনীয় মনোভাবই স্পষ্ট করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত ন্যূনতম ছাড় দিয়ে হলেও সমঝোতার একটি মনোভাব সরকারের মধ্যে দেখা দেবে। তবে সম্ভাব্য ওই পরিস্থিতির পরও সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলে তখনই কেবল ‘অল আউট’ আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংলাপের মধ্য দিয়ে বিএনপি সমঝোতায় যাওয়ার পক্ষপাতী। আমরা মনে করি, এই সমঝোতার সুযোগ এখনো আছে। কিন্তু সরকার শেষ পর্যন্ত কঠোর অবস্থানে থাকলে তার অর্থ বিএনপিকে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেওয়া। তখন আমাদের আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিএনপি সমঝোতার পথেই যেতে চায়। আর এ জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালাব।’ তিনি বলেন, সরকার আন্দোলনের পথে ঠেলে দিলেই বিএনপি আন্দোলনে যাবে। তাঁর মতে, সংঘাত বিএনপি তৈরি করবে না, এটা নিশ্চিত। কিন্তু বিএনপিকে দুর্বল মনে করা হলে ভুল হবে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, সরকারের মনোভাব শেষ পর্যন্ত কঠোর বা অনমনীয় থাকলে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাব দিয়েও কোনো লাভ হবে না। তাঁদের মতে, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান বড় দুই দলের সমঝোতার মধ্য দিয়ে সংসদে পাস হয়েছিল। ওই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মধ্য দিয়ে পর্দার আড়ালে কোনো সমঝোতা হয় কি না, তার জন্য বিএনপি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালাবে। তবে ওই চেষ্টা ভেস্তে গেলে বিএনপি এমন এক সময় সহায়ক সরকারের প্রস্তাব জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে, যাতে সে ইস্যুতে আন্দোলন টেনে নেওয়া যায় নির্বাচন পর্যন্ত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সহায়ক সরকারের প্রস্তাব প্রস্তুত আছে। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে সরকারও একটি অংশ। ১৯৯৬ সালে বিএনপি রাজি হয়েছিল বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে বিল সংসদে পাস হয়েছিল। ফলে এখনো সমঝোতা করেই প্রস্তাব দেওয়া ভালো। ওই নেতা আরো বলেন, বিএনপি প্রস্তাব দিল; কিন্তু সরকার মানল না, এমন প্রস্তাব দিয়ে লাভ কী!
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, সহায়ক সরকারের প্রস্তাব উপযুক্ত সময়ে দেওয়া হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সহায়ক সরকারের প্রস্তাব সময়মতো দেওয়া হবে। ওই প্রস্তাবে এমন কিছু থাকবে, যা সরকারের জন্য মানা খুব কঠিন হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো প্রস্তাব দেয়, সেখানে কি খালেদা জিয়াকে ওই সরকারের প্রধান হিসেবে তারা মেনে নেবে? তেমনি বিএনপিও শেখ হাসিনাকে মেনে নেবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সহায়ক সরকারের প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ জড়িত। এখনই দিলে গণমাধ্যমে কিছুদিন লেখালেখি হবে, তারপর মানুষ ভুলে যাবে। ফলে সময়ের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রস্তাব দেওয়া হবে। এ ছাড়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত টেনে নেওয়ারও একটি বিষয় আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কোনো আলাপ বা সমঝোতা হচ্ছে কি না, এ বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই।
দলের একাধিক সূত্রে জানা যায়, বিএনপি নেতারা আপাতত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলার সম্ভাব্য রায় নিয়ে বেশি ব্যস্ত; যদিও তাঁদের বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সাজা হবে না। কিন্তু বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে চাপে রাখতেই মামলার কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে চলছে।
বিএনপির অনেক নেতা মনে করেন, সাজা হলে একদিকে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বাড়বে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে স্পষ্ট হবে যে একতরফা নির্বাচনের জন্যই খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত খালেদার সাজা না-ও হতে পারে।
বিএনপি নেতারা আরো মনে করেন, বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে যাতে বিএনপি নির্বাচনে যায় সে লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি করা যেমন সরকারের কৌশল, তেমনি নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যাতে নতুন কর্মকৌশল প্রণয়ন তথা শক্তি সঞ্চয় না করতে পারে সে জন্য দলটিকে ব্যতিব্যস্ত রাখাও সরকারের আরেকটি কৌশল। কিন্তু নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলে সরকার আস্তে আস্তে চাপের মুখে পড়বে। কারণ তখন প্রশাসনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের তত্পরতাও বাড়বে। ওই অবস্থায় সহায়ক সরকারের ইস্যু জনগণের সামনে আনতে চায় বিএনপি। পাশাপাশি এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে যোগাযোগও করতে চায় তারা। সব দিক বিবেচনায় রেখে এখনই রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করতে রাজি নয় বিএনপি। বরং ইতিবাচক পথে থেকে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখাই এখন দলটির লক্ষ্য, যাতে নির্বাচন পর্যন্ত দলকে গতিশীল রাখা যায়।
গত ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যাবে না, আমরা নির্বাচন করব।’ বিএনপির অনেক নেতার মতে, ওই বক্তব্যের মধ্যে নতুন তাত্পর্য রয়েছে। খালেদা জিয়া নির্বাচনের পথে হাঁটছেন বলে মনে করা হচ্ছে।