গত বছর সদস্য সংগ্রহ অভিযান এবং বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে দল গোছানোর চেষ্টা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে বছরের শেষ ভাগে এসে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য বিরোধ ছিল রাজনীতিতে বেশ আলোচনার বিষয়। অভ্যন্তরীণ বিরোধে পার্ল হারবারের সামনে সিটি করপোরেশনের ময়লার স্তূপে চরম ইমেজ সঙ্কটে পড়ে দল। বছরের শুরুর দিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের হাইব্রিড, ফার্মের মুরগি ও কাউয়া আখ্যায়িত করে বেশ হাস্যরসেরও সৃষ্টি করেন। তার এসব মন্তব্যে দলীয় ফোরামে তীব্র সমালোচনাও হয়। বছরজুড়ে দল হারিয়েছে কয়েকজন জনপ্রিয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিকে। তবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন ও আনন্দের।
আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাংগঠনিক গতি বাড়াতে সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহকার্যক্রম শুরু করে আওয়ামী লীগ। গত ২০ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত দলের বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সদস্যপদ নবায়ন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। তবে গত ছয় মাসেও কাক্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি দলটি। দেড় কোটি নতুন সদস্য টার্গেট করা হলেও সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রায় অর্ধকোটি সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে এ কার্যক্রমকে গতিশীল করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ১৮ মার্চ সারা দেশে সাংগঠনিক জেলা সফর শুরু করেন। এরপর সদস্য সংগ্রহ অভিযানে গতি বাড়াতে ৩ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সারা দেশের সাংগঠনিক জেলায় চিঠি ইস্যু করেন। চিঠিতে যেসব সাংগঠনিক জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌর শাখা ফরম সংগ্রহ করেনি অতি দ্রুত তাদের আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করে এলাকায় সদস্যপদ সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচি জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়।
কিন্তু তাতেও গতি পায়নি সদস্য সংগ্রহ অভিযান। গতি না পাওয়ার কারণ হিসেবে একাধিক নেতা জানান, শোকের মাস আগস্ট, বন্যা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেন্দ্রীয় নেতারা অনেক ব্যস্ত সময় পার করেছেন। বিশেষ করে দেশের অর্ধেক জেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি ও হঠাৎ করে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমে আসায় সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বিঘিœত হয়েছে দলের সদস্য সংগ্রহকার্যক্রমও।
তৃণমূলপর্যায়ে দলকে চাঙ্গা করতে বিভাগীয় সমাবেশ করে দলটি। রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগে ইতোমধ্যেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক নানা কর্মসূচি পালন ছাড়া তেমন কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল না দলটির।
বছরের শেষ দিকে এসে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও মেয়র সাঈদ খোকনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি থেকে পর্যায়ক্রমে তা জড়ায় নজিরবিহীন সংঘর্ষে। দুই নেতার বিরোধে দলের বর্ধিত সভাস্থল পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ময়লার স্তূপ রেখে বেশ আলোচনায় স্থান পান মেয়র সাঈদ খোকন। শুধু তাই নয়, ময়লার স্তূপের পর দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বর্ধিত সভাও পণ্ড হয়ে যায়। পরে উল্লিখিত দুই নেতাকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। ওই বৈঠকে মেয়র সাঈদ খোকনকে তুলোধুনো করে দুইজনকে মিলিয়ে দেয়া হলে পরিস্থিতি আপাত শান্ত হয়।
বছরের শুরুর দিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলের কিছু নেতাকর্মীকে হাইব্রিড, ফার্মের মুরগি ও কাউয়া বলে আখ্যায়িত করেন। তার এমন মন্তব্যে রাজনীতিতে বেশ হাস্যরসের জন্ম দেয়। অন্য দিকে দলের সাধারণ সম্পাদকের এসব মন্তব্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে নেতাকর্মী ও হাইকমান্ডে। বিভিন্ন ফোরামে তার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা হলে তিনি এসব বক্তব্য থেকে বিরত থাকছেন।
এদিকে গত বছরটি ছিল আওয়ামী লীগের জন্য জনপ্রিয় নেতাদের হারানোর বছর। গত ১৪ ডিসেম্বর প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যান। ৭৪ বছরের জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন ১৬ বছর। একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধা আমৃত্যু ছিলেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। চট্টলার মানুষের প্রিয় নেতা মহিউদ্দীন চৌধুরীর কুলখানির দিন ঘটল আরেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। তার কুলখানিতে অংশ নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন। এ ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
এর আগে গত ২৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক। গত ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান মেয়র আনিসুল হক। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ১৩ আগস্ট তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে দীর্ঘ দিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। অবশেষে ২৯ নভেম্বর রাতে মেয়রকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। নগরবাসীর জন্য আধুনিক শহরের স্বপ্নদ্রষ্টা আনিসুল হকের মৃত্যুতে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল দলমত নির্বিশেষে সবাই। বছরের প্রথম দিকে দলের প্রবীণ নেতা বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পরলোক গমন করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্ট এ পার্লামেন্টারিয়ান ও আলোচিত রাজনীতিকের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন দলের নেতাকর্মীরা।
এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি, ব্যবসায়ী ও একসময়কার টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আনিসুল হক ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫২ সালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার শৈশবের একটি বড় সময় কাটে ফেনীর সোনাগাজীর নানাবাড়ি।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে টিভি উপস্থাপক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন আনিসুল হক। তার উপস্থাপনায় ‘আনন্দমেলা’ ও ‘অন্তরালে’ অনুষ্ঠান দুটি জনপ্রিয়তা পায়। তবে পরে টেলিভিশনের পর্দায় মানুষ তাকে বেশি দেখেছিল ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেই। ২০০৫-৬ সালে বিজিএমইএর সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি হন তিনি। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল মেয়াদে সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন আনিসুল হক।
গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে না ফেরার দেশে চলে যান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বর্ষীয়ান রাজনীতিক মোহাম্মদ ছায়েদুল হক। সাদা মনের মানুষ ও নির্লোভ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে তার এলাকা নাসিরনগরসহ বিভিন্ন মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এ ছাড়া গত ১৯ ডিসেম্বর মারা যান গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক গোলাম মোস্তফা আহমেদ। গত ১৮ নভেম্বর নিজের নির্বাচনী এলাকা থেকে মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় আসার পথে টাঙ্গাইলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা। টাঙ্গাইলের নাটিয়াপাড়ায় রংপুরগামী বাসের সাথে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে এমপি ও তার গাড়ির চালকসহ চারজন আহত হন।
এমপি মোস্তফার মাথার আঘাত গুরুতর হওয়ায় টাঙ্গাইল সদর হাসপাতাল থেকে তাকে ওই রাতেই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এরপর তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। তার মৃত্যুর পর ওই আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। এরপর ওই আসনে এ বছরের ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে জয়ী হন গোলাম মোস্তফা আহমেদ।
এদিকে বছরজুড়ে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। গত ৩০ অক্টোবর ইউনাইটেড ন্যাশন এডুকেশন, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেস্কো) ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে (ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ) বিশ্বে প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। প্যারিসে ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক ইরিনা বুকোভা এই ঘোষণা দেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের আন্তর্জাতিক রেজিস্টার স্মৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি ইউনেস্কো কর্তৃক তৈরি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের একটি তালিকা। আন্তর্জাতিকভাবে রেজিস্টারকৃত এই তালিকা তৈরির উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঐতিহ্যগত প্রামাণ্য দলিলের সংরণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজারি কমিটি (আইএসি) কোনো প্রামাণ্য দলিল বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে রেজিস্টার হবে কি না বা যোগ্য কি না তা বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। এই কমিটি এ বছর ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর আয়োজিত সংগঠনটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বে আন্তর্জাতিক রেজিস্টার্ড মেমোরি হিসেবে মনোনীত করে। বর্তমানে ম্যামোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে সব মহাদেশ থেকে ৪২৭টি প্রামাণ্য দলিল ও সংগ্রহ তালিকাভুক্ত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভাষণটি স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রস্তুতির দিকে ঝুঁকে পড়তেও উৎসাহিত করে। এটি মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণের অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।