শিরিণ আক্তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগ থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স পাস করেছেন ১৯৯৬ সালে। তার স্বামী এহসানুল করিমও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই সালে মার্কেটিং বিভাগ থেকে অনার্সসহ এমবিএ পাস করেন। শিরিণ ও তার স্বামী দুইজনেই নাটারের বড়াইগ্রাম মডেল কলেজে শিক্ষকতা করছেন ১৯৯৮ থেকে। দুইজনের কারোরই বেতন নেই।
সাবিনা ইয়াসমিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স পাস করেছেন ১৯৯৮ সালে। তিনি বগুড়ার শেরপুরে অবস্থিত সীমাবাড়ি মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। কলেজটি ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখন থেকে গত ১৯ বছর ধরে তিনিও বিনা বেতনে চাকরি করে যাচ্ছেন।
গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস কাবে শিরিণ আক্তার ও সাবিনা ইয়াসমিন পাশাপাশি বসেছিলেন অনশনরত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্মচারীদের সাথে। প্রতিদিন সকালে এসে তারা কর্মসূচিতে যোগ দেন। এরপর রাতে চলে যান কোনো আত্মীয়ের বাসায়।
শিরিণ আক্তার, সাবিনা ইয়াসমিনের মতো অসংখ্য শিক্ষক রয়েছেন যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন নামকরা কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স করেও বছরের পর বছর বিনা বেতনে চাকরি করে যাচ্ছন বিভিন্ন নন-এমপিও স্কুল-কলেজে। দেশের উচ্চশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের বাস্তব চিত্রের একটি নাজুক দিক এটি।
বেতন না হলেও কেন বছরের পর বছর পড়ে আছেন জানতে চাইলে অনশনে অংশ নেয়া উচ্চশিক্ষিত অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা জানিয়েছেন, তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন সেগুলো সব সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি প্রতিষ্ঠান যখন স্বীকৃতি পায় তখন থেকেই সেটি এমপিও পাওয়ার উপযুক্ত হয়। কারণ শর্ত পূরণ করে যোগ্যতা অর্জন করার পরই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু স্বীকৃতি দেয়ার পরও এমপিওভুক্ত করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা। প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি পাবার পর সবাই আশায় থাকেন এক দিন এমপিও হবে। কারণ একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে অতীতে নিয়মিতভাবে এটি করা হয়েছে। কিন্তু ২০০৫ সালের পর দীর্ঘ দিন ধরে এমপিওকরণ বন্ধ থাকায় আমরা ভাগ্যের ফেরে পড়ে গেছি।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর আশা দেয়া হয়েছে এমপিও হবে। কিন্তু সে আশা এভাবে মিথ্যায় পরিণত হবে তা আমরা ভাবতে পারিনি। প্রতি বছরই ভেবেছি পরের বছর হবে। এভাবে একটি মোহে পড়ে আমরা এত বছর পার করেছি। তাই এবার আর দাবি আদায় না করে বাড়ি ফিরব না।
অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা জানান, তারা শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছেন শৈশব থেকে লালিত একটি স্বপ্ন থেকে। সমাজে মানুষের সামনে নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসেবে তুলে ধরে ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ শিক্ষা দেবেন।
কেউ কেউ বলেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে চেষ্টা করেও ঘুষ দুর্নীতির কারণে চাকরি হয়নি অনেকের। তাই নিরূপায় হয়ে পড়ে আছেন শিক্ষকতায়।
শিক্ষকেরা বলেন, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। সমাজের কল্যাণ সাধনের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন বিভিন্ন ব্যক্তি। শিক্ষা বিস্তার রাষ্ট্রের কাজ। সে কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হাজার হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই এমপিওভুক্তি পাওয়া আমাদের অধিকার।
অনশনে অংশ নেয়া পটুয়াখালীর বক্ষিয়া সাঈদীয়া কলেজের প্রভাষক ফাহমিদা জাহান বলেন, আমি জীববিদ্যা বিভাগে অনার্সে ফার্স্ট কাস পাওয়া। ২০০৩ সাল থেকে বিনা বেতনে চাকরি করছি এক দিন এমপিও হবে এই আশায়।
বিনা বেতনে কেন বছরের পর বছর চাকরি করছেন জানতে চাইলে বরিশালের উজিরপুরে অবস্থিত জল্লা ইউনিয়ন আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ ড. বিনয় ভূষণ রায় নয়া দিগন্তকে বলেন, কথায় আছে পিঠা খায় মিঠার লোভে। আমরা মিঠার লোভে পড়ে আছি, এক দিন এমপিওভুক্ত হবে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, ২০০১ সাল থেকে তিনি বিনা বেতনে অধ্যক্ষ পদে চাকরি করছেন।
বাহাজউদ্দিন জানান, তিনি সখীপুর টাঙ্গাইলের পলাশতলী মহাবিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক। আবুজর গিফারী কলেজ থেকে তিনি অনার্স মাস্টার্স পাস করেছেন। ১২ বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরি করছেন। বাহাজউদ্দিনের সাথে অনশনে রয়েছেন তার সহকর্মী আমিনুল ইসলাম। তিনি সরকারি সা’দত কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অনার্স মাস্টার্স পাস করেছেন। তিনি উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত।
শফিউল ইসলাম গাইবান্ধার ফুলছড়িতে অবস্থিত হুদাখালি মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ। তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স করার পর ১৯৯৯ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। শফিউল ইসলাম বলেন, স্বপ্ন ছিল এলাকায় শিক্ষার আলো জ্বালাব। শিক্ষার মাধ্যমে সুন্দর সমাজ দেশ গঠনে ভূমিকা পালন করব। ২০০৫ সালে আমাদের কলেজটি সরকার স্বীকৃতি দিলেও আজ অবধি এমপিও করা হয়নি।
বেতনহীন চাকরিজীবন বড় কষ্টের : বিনা বেতনে চাকরিরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিরিণ আক্তারের এক ছেলে এবার জেএসসি পাস করেছে। শিরিণ বলেন, ছেলে কিছু চাইলে না দিতে পারলে বলে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে তোমরা কী করছ। আমরা লেখাপড়া করে কী হবে। লেখাপড়া না করে অন্য কোনো কাজ করলে টাকা পাওয়া যাবে। ছেলের এসব কথার কোনো জবাব দিতে পারেন না বলে আফসোস করে জানালেন শিরিণ আক্তার।
তিনি বলেন, আমি লালমাটিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমার অন্যান্য আত্মীয়স্বজন প্রতিষ্ঠিত এবং অনেকে ঢাকায় রয়েছেন। আমি ও আমার স্বামী দুইজনেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও আজ বিড়ম্বনার শিকার। অনেক স্বপ্ন ছিল কলেজে শিক্ষকতা করব আর নিরিবিলি সংসার করব। সে আশা থেকেই শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলাম। এক দিন এমপিও হবে এ আশায় আশায় এতটা বছর পার হয়ে গেল। বেতনহীন অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী মিলে টেনেটুনে সংসার চালাই। বেতনহীন চাকরি জীবন বড় কষ্ট আর বিড়ম্বনার জীবন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সাবিনা ইয়াসমীনের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে এ বছর জেএসসি পাস করেছে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে। সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ছেলের কোনো সখ পূরণ করতে না পারলে সে অভিযোগ করে কেন চাকরি করছ আর কেনই বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে। সাবিনা ইয়াসমীন বলেন, মা-বাবা টাকা খরচ করেন অনেক আশায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন। কিন্তু তাদের জন্য, শ্বশুর-শাশুড়ি কারোর জন্য কিছু করতে পারি না আমরা। ঈদ উৎসবে ভালো কিছু দিতে পারি না ছেলে মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনদের।
মাগুরার শালিখা উপজেলার শিংড়ায় অবস্থিত সরস্বতী শিকদার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে প্রভাষক বিকাশ পাত্র, সুকণ্ঠ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, প্রতাপ বিশ্বাস, খোকন বিশ্বাস যোগ দিয়েছেন অনশন কর্মসূচিতে। তাদের দুইজন ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ এবং তিনজন যশোর সরকারি এম এম কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স পাস করে শিক্ষকতা করছেন বিনা বেতনে।
সারা দেশে পাঁচ হাজার ২৪২টি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওকরণের দাবিতে শিক্ষকেরা গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেস কাবের সামনে আমরণ অনশন পালন করছেন। এতে যোগ দিয়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষক- শিক্ষিকা কর্মচারী।