সময়টা এখন যেন কারও অনুকূলে নেই। থাকবে কী করে! মুসলিম বিশ্বে ঐক্য অধরা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, হানাহানি, বিভেদ প্রকট। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সংঘাত বেড়েছে। বেড়েছে রক্তপাত। কিন্তু ক্ষতিটা হচ্ছে মুসলমানেরই। রক্ত ঝরলে তা কোনো না কোনো মুসলমানেরই ঝরছে। মুসলিম বিশ্বের এই ক্রান্তিকাল তার নেতৃত্বের সংকটকে স্পষ্ট করে তোলে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি প্রশ্ন রাখা হয়, মুসলিম বিশ্বের নেতা কে? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া কঠিন। আর উত্তর এলেও তা হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বিদ্যমান বাস্তবতায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের কথা বললে সম্ভাব্য তিনটি দেশের নাম সামনে চলে আসে। সৌদি আরব, ইরান ও তুরস্ক।
অনেক দিন ধরেই মুসলিম বিশ্ব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সংকট উত্তরণে সুন্নি রাষ্ট্র সৌদি আরব প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি। নিতে পারেনি নেতৃত্বের আসন। বরং সৌদি আরবের আধিপত্যশীল আচরণে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের তিক্ততা মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই পুরো মুসলিম বিশ্বকেই প্রভাবিত করেছে। গত বছরই জোট বেঁধে কাতারকে একঘরে করে সৌদি আরব। রিয়াদের এই পদক্ষেপ মুসলিম বিশ্বকে আরও দুর্বল করেছে। ইয়েমেনে দিনের পর দিন বোমা ফেলছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। ইতিমধ্যে দেশটিতে বহু মানুষের প্রাণ গেছে। ইয়েমেনে চলছে দুর্ভিক্ষ। সমালোচনা সত্ত্বেও রিয়াদের থামার কোনো লক্ষণ নেই।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরান আলোচিত নাম। মুসলিম বিশ্বে ইরানের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তেহরানের সামরিক শক্তির দিকটি স্বীকৃত। কিন্তু আন্তর্জাতিক অবরোধে ইরান জর্জরিত। দেশটির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা চাপ মোকাবিলার পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ রিয়াদকেও সামাল দিতে তেহরানকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের নানান সংকটে তেহরানের কণ্ঠ উচ্চকিত। কিন্তু শিয়া রাষ্ট্র হওয়ায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের জায়গাটি নিজের করে নিতে পারছে না ইরান।
সামরিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্ক। তারা সামরিক জোট ন্যাটোরও সদস্য। কামাল আতাতুর্কের আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রের নীতির কারণে তুরস্ক সম্পর্কে ইসলামি বিশ্বে একধরনের দ্বিধা লক্ষ করা গেছে। তবে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আমলে তুরস্কের ভাবমূর্তির বদল ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্বকাল মিলিয়ে এরদোয়ান অনেক দিন ধরেই তুরস্কের ক্ষমতায় আছেন। তিনি ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত। তুরস্কে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে কাজ করছেন তিনি। এরদোয়ানের জোর প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে ইসলামিক বিশ্বে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আঙ্কারা।
বিশেষ করে ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পর তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। অধিকতর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন তিনি। এখন তো তাঁকে অনেকে তুরস্কের নতুন সুলতান সুলেমান বলেও অভিহিত করেন। এরদোয়ান শুধু নিজ দেশের সুলতান হতে চান না; তাঁর লক্ষ্য আরও বড়। তিনি মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চান। এই লক্ষ্য থেকেই ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাসহ (ওআইসি) বিভিন্ন ফোরাম ও উপলক্ষে এরদোয়ান নিজের যোগ্যতা তুলে ধরছেন। এই যেমন ২০১৬ সালের এপ্রিলে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে এরদোয়ান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘আমি সুন্নি বা শিয়া নই, আমার ধর্ম ইসলাম।’
সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে এরদোয়ানকেই সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকায় দেখা যায়। রোহিঙ্গা সংকটে এরদোয়ানের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তাজ হাশমি এই মত দেন যে এরদোয়ান তুরস্কের হারানো শৌর্যবীর্য ফিরিয়ে আনতে চান। একই সঙ্গে তুরস্ককে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে তিনি হতে চান মুসলিম বিশ্বের প্রধান নেতা।
রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যেই জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি মুসলিম বিশ্বকে একটা বড় ধরনের পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই সংকটের শুরু থেকেই যথারীতি সোচ্চার এরদোয়ান। তিনি হয়ে ওঠেন ফিলিস্তিনি তথা সারা বিশ্বের মুসলমানদের কণ্ঠস্বর। তাঁর ভূমিকা ও তৎপরতা মুসলিম বিশ্বের নজর কেড়েছে। ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।
মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের জায়গায় একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। সৌদি আরবের বাদশা সালমানের নেতৃত্ব নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কার্যত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরব চালাচ্ছেন। তিনি বয়সে খুবই তরুণ। নেতৃত্বের জায়গায় আসতে তাঁকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও খুব একটা ক্যারিশমা দেখাতে পারছেন না। এখন এরদোয়ানের সামনে সুবর্ণ সুযোগ।