ইয়াবা কারবারি দুই বোনের শতকোটি টাকা

Slider সারাদেশ

20141103225333_Yaba

 

 

 

 

পুরান ঢাকায় একটি ইলেকট্রনিক পণ্যের গোডাউনের মালিক নাছির উদ্দিন। চীন থেকে পণ্য এনে ঢাকায় বিক্রি করেন তিনি।

আশপাশের ব্যবসায়ীদের কাছে এমনই ছিল পরিচয়। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তদন্তে বেরিয়ে এলো তাঁর ভয়ংকর পরিচয়। জানা গেল, এই নাছিরই চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নিজ এলাকায় ইয়াবা নাছির নামে পরিচিত। তিনি তাঁর কথিত ইলেকট্রনিক পণ্যের গোডাউনটিতে ইয়াবা মজুদ করতেন। সেখান থেকে লাখ লাখ ইয়াবা বড়ি বিক্রি করতেন একটি নারী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এ চক্রের দুই কোটিপতি নারী সদস্যকে ধরার পর বের হয় আসল তথ্য, যাঁরা পরস্পরের সহোদর বোন।

রাজধানীতে বসবাসকারী কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আসমা আহমেদ ডালিয়া ও স্বপ্না আক্তার নামে এই দুই বোন ইয়াবার কারবার করে এখন শতকোটি টাকার মালিক। ঢাকার হাতিরপুলে ‘রেইন বাথ’ নামে একটি স্যানিটারি পণ্যের দোকানের আড়ালে চলে তাঁদের ইয়াবা কারবার। মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ গড়ে তোলা এই দুই বোনের ঢাকায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, রয়েছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা; যা মাত্র চার-পাঁচ বছরের মাথায় তাঁরা অর্জন করেছেন।

ইয়াবা তাঁদের কাছে রীতিমতো আলাদিনের চেরাগ। তাঁরা ইয়াবা নাছিরের সহায়তায় নিজেদের পুরো পরিবারকেই ইয়াবা কারবারে জড়িয়েছেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হচ্ছে না। গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার পর এখন তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন জানাতে যাচ্ছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে চক্রটির শীর্ষ ইয়াবা কারবারি নাছির এখনো পলাতক।

নিউ মার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছেন ডিএনসির তদন্ত কর্মকর্তা। চার্জশিটে অভিযুক্তরা হলেন আসমা আহমেদ ডালিয়া, তাঁর স্বামী রবিউল ইসলাম, মা মনোয়ারা বেগম ও ইয়াবা গডফাদার নাছির উদ্দিন। তদন্ত কর্মকর্তা, ডিএনসির পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন ভুইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, নাছির শীর্ষ ইয়াবা কারবারি। রাজধানীর বংশালের নবাবপুর রোডের এমএস মার্কেটের তৃতীয় তলায় তাঁর চীন ইলেকট্রনিক পণ্যের গোডাউনের আড়ালে চালিয়েছেন ইয়াবা কারবার। এসএ পরিবহনের কুরিয়ার সার্ভিসে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের ব্রাঞ্চে আসত ইয়াবার চালান। তিনি কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে নিজের নামেই ঢাকায় চালান পাঠাতেন। এরপর হোটেলে বসে সেই চালান গ্রহণ করতেন। পরে ইমোতে ডালিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াবা সরবরাহ করা হতো। তিনি জানান, আরেকটি মামলায় ডালিয়ার বোন স্বপ্নাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হবে।

গত ৯ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান, এলিফ্যান্ট রোড ও পশ্চিম রাজাবাজারে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার ইয়াবাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেন ডিএনসি কর্মকর্তারা। এর মধ্যে এলিফ্যান্ট রোডে বাটা সিগন্যালের কাছে ১৭৩ নম্বর সিদ্দিক প্লাজার নবমতলার ৮/বি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে ডালিয়া ও রবিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছে পাওয়া যায় ৩২ হাজার পিস ইয়াবা ও দেড় লাখ টাকা। আর উত্তর ধানমণ্ডির কলাবাগানের ৪৮ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাট থেকে স্বপ্না, তাঁর স্বামী শামিম আহমেদ ও ফুফু মাহমুদা রানীকে ছয় হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। আর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫২/এ নম্বর সাততলা বাড়ির তৃতীয় তলায় ২/বি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে আসমা নামের এক নারী ও স্বপ্নার মা মনোয়ারাকে ১২ হাজার পিস ইয়াবা এবং এক লাখ ৩০ হাজার টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় ব্র্যাক ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের তিনটি অ্যাকাউন্টের কাগজপত্রও জব্দ করা হয়। এসব অভিযানের ঘটনায় নিউ মার্কেট ও শেরেবাংলানগর থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার তদন্তেই উঠে আসে শীর্ষ ইয়াবা কারবারি নাছির উদ্দিন ওরফে ইয়াবা নাছিরের নাম।

সূত্র জানায়, গত ১২ অক্টোবর রাতে বংশালের নবাবপুর রোডের ১৬৭ নম্বর বাড়িতে এমএস মার্কেটের তৃতীয় তলায় নাছিরের গোডাউন থেকে ২০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে ডিএনসি। তবে চতুর নাছির আগেই সটকে পড়েন।

ডিএনসির সহকারী পরিচালক (এডি) মোহাম্মদ খোরশিদ আলম বলেন, নাছির প্রতি চালানে এক থেকে পাঁচ লাখ ইয়াবা আনতেন। ইয়াবা মজুদের জন্যই নাছির বড় গোডাউন ভাড়া নেন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার দক্ষিণ ছহুদা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ইসমাইল। এলাকায় ইয়াবা নাছির বলে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে সাতকানিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ ও ঢাকায় এক ডজন মামলা আছে।

ডিএনসির সূত্র জানায়, ফ্ল্যাটে ও গুদামে রেখে নারীদের মাধ্যমে ইয়াবা বিক্রি করে পুরো চক্রটি গত চার বছরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। আদালতের নির্দেশে আসামি ডালিয়ার ব্র্যাক ব্যাংকের দুটি ও রবিউলের একটি ব্যাংক হিসাব তল্লাশি করে ডিএনসি। সেখানে কোটি কোটি টাকার লেনদেন এবং স্থির দুই কোটি ২৭ লাখ টাকা পাওয়া যায়। এসব টাকা বাজেয়াপ্ত করার জন্য আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। স্বপ্নার ব্যাংক হিসাবও তল্লাশি করা হবে। এলিফ্যান্ট রোডের সিদ্দিক প্লাজার নবমতলায় এক হাজার ৬৬০ স্কয়ার ফিটের ৮/বি নম্বর ফ্ল্যাটটির মালিক ডালিয়া। কলাবাগানের হাসনাহেনা অ্যাপার্টমেন্টের এক হাজার ৮০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের মালিক স্বপ্না। ডালিয়ার এলিয়ন গাড়িটি ডিএনসি জব্দ করলেও হোন্ডা কম্পানির আরেকটি দামি গাড়ি পড়ে আছে স্বপ্নার বাসার গ্যারেজে। মাদক কারবারি তিনটি পরিবারের অন্যান্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আবেদন করা হবে বলেও জানান তদন্তকারীরা।

সূত্র জানায়, ডালিয়া ও স্বপ্নার বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। একসময় ছিল অভাবের সংসার। চার-পাঁচ বছর আগে তাঁরা পারিবারিকভাবে ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ে। ইয়াবা বিক্রির টাকায় মালয়েশিয়ায় কেনা বাড়িতে বসবাস করছে ডালিয়ার বড় ছেলে ও তার খালা শিলা। ডালিয়ার ছোট ছেলে পড়ালেখা করছে ধানমণ্ডির একটি নামিদামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ডালিয়াদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরের বড় পিপুলিয়া গ্রামে। ডালিয়ার স্বামী রবিউল ইসলামের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর। ২০০৯ সালে রবিউলের বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থানায় একটি মাদক মামলা হয়। ডালিয়ার বোন স্বপ্নার আগেও একটি বিয়ে হয়েছিল। তবে সেই সংসার বেশি দিন টেকেনি। পরে তিনি শামিমকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *