ড্যানি বোম্যান থাকেন যুক্তরাজ্যে। ১৯ বছরের এই তরুণের ঘণ্টায় কয়েকটা করে সেলফি না তুললেই নয়। প্রতিদিন গড়ে ২০০টি করে সেলফি তোলেন ড্যানি! দিনে ১০ ঘণ্টা তিনি ব্যয় করেন মোবাইলের ক্যামেরার সামনেই। একপর্যায়ে সেলফির নেশায় গুরুতর মানসিক সমস্যায় পড়েন ড্যানি। কমেতে থাকে ওজন। কাঙ্ক্ষিত মানের সেলফি তুলতে না পারায় বাড়তে থাকে হতাশা। একপর্যায়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও চালান ড্যানি।
সে যাত্রা অবশ্য মায়ের কল্যাণে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন ড্যানি। পরে পুনর্বাসন কার্যক্রম ও মানসিক চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত সেলফি তোলাকে ক্ষতিকর কিছু মনে না হলেও, আদতে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে গুরুতর। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে যেমন এর প্রমাণ মিলেছে, তেমনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও অতিরিক্ত সেলফি তোলার বিপক্ষে রায় দিয়েছেন।
ডিআইওয়াই হেলথ অ্যাকাডেমিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেলফি তোলার সঙ্গে আত্মমগ্নতা বা আত্ম মুগ্ধতার (নার্সিজম) সম্পর্ক রয়েছে। নিখুঁত সেলফি তোলার জন্য বারবার চেষ্টা করতে গিয়ে তা একসময় নেশায় পরিণত হতে পারে। আবার নিজের নিখুঁত ছবিটি তুলতে না পারার ব্যর্থতা অযাচিত হতাশার জন্ম দিতে পারে।
ওই প্রতিবেদনে মনোরোগ চিকিৎসক ডেভিড ভিল বলেছেন, তাঁর কাছে যত রোগী আসেন-তার প্রতি তিনজনের দুজন বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত থাকেন। এটি এমন এক ধরনের মানসিক সমস্যা, যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের চেহারার খুঁত নিয়ে অনবরত চিন্তায় থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রচুর পরিমাণে সেলফি তোলেন এবং সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করেন। সেখানে অন্যান্য পরিচিতজনদের করা মন্তব্য থেকেই ধীরে ধীরে তাঁরা এই রোগে আক্রান্ত হন।
হাফিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক গবেষণাতেও দেখা গেছে যে, যারা অনলাইনে নিজেদের বেশি বেশি ছবি আপলোড করেন, তাঁরা আত্ম মুগ্ধতা ও নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগেন। ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সের ৮০০ মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়েছিল ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি। তাঁদের অনলাইনে একটি প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিতে বলা হয়েছিল। গবেষকেরা ফলাফলে দেখতে পান, বেশি বেশি নিজের ছবি আপলোড করার সঙ্গে আত্ম মুগ্ধতা ও সাইকোপ্যাথির আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। আপলোডের আগে নিজের ছবি সম্পাদনা করার সঙ্গে শুধু আত্ম মুগ্ধতার সম্পর্ক পাওয়া গেছে। আবার ছবি সম্পাদনার সঙ্গে নিজের চেহারার খুঁত নিয়ে অসন্তুষ্টির বিষয়টিও ফুটে ওঠে।
ডিআইওয়াই হেলথ অ্যাকাডেমি প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে আত্ম মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে বেশি। ডিজিটাল মাধ্যম মানুষের জীবনে অবাস্তব লক্ষ্যে নির্ধারণে প্ররোচিত করছে। আর তা পূরণ না হলেই বাড়ছে হতাশা। বিশ্বজুড়ে অনেকেই এখন সামাজিক মাধ্যমে আসক্ত। আর সেলফি হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের হাতিয়ার। কেউ কেউ এ থেকে উদ্ধার পেতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও বেশির ভাগই বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছেন না। ফলে সমস্যা আরও গভীর হচ্ছে।
যদিও অনেকে মনে করেন যে, কম আত্মবিশ্বাস থাকা ব্যক্তির জন্য সামাজিক মাধ্যম উপকারী ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে আদতে এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ভালো নয়। কারণ প্রাথমিকভাবে একজন কম আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তি তাঁর সেলফি আপলোড করে লাইক ও কমেন্ট পেয়ে উৎসাহিত বোধ করতেই পারেন। কিন্তু তিনি যদি সামাজিক মাধ্যমকেই তাঁর আত্মবিশ্বাসের উৎস হিসাবে বিবেচনা করেন, তবেই ভুল হবে। কারণ এই ডিজিটাল মাধ্যম কোনোভাবেই আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণার সুস্থ উৎস হতে পারে না এবং তা থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া সব সময় ইতিবাচকও হবে না। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি নির্ভরশীল ব্যক্তিদের এক সময় হতাশায় নিমজ্জিত হতে হয়। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। তাই সেলফি তোলায় যত কম সময় ব্যয় করা যায়, ততই মঙ্গল।