একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই কমিটি গঠন করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন তিন সদস্যের এই কমিটির প্রধান। ১০ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এই প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁরা বিভিন্ন উপায়ে অর্থ আদায় করেছেন। তদন্তে এবং অনুসন্ধানে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে এমন অন্তত চারটি ঘটনায় টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান ও তাঁর সহকর্মী এসআই জুলহাস আহমেদ, এএসআই সানাউল্লাহ এবং সিপাহি আনোয়ার হোসেন, জিয়াউল হক ও আমজাদ।
জানতে চাইলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) জামাল উদ্দিন বলেন, জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ভারতের সীমান্তবর্তী এবং দেশে মাদক পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে পরিচিত। মাদকপ্রবণ এলাকা হিসেবে সেখানে মাদক ব্যবসায়ীদের প্রভাব রয়েছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিপাহি জিয়াউল হক মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন এবং অবৈধ চাঁদা আদায়ে পরিদর্শক জিল্লুরকে সহায়তা করেন। আগের পরিদর্শককেও জিয়াউল সহায়তা করেছেন মর্মে তথ্য পায় কমিটি। জিয়াউলের নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কমিটি বলেছে, বারবার বদলি করা হলেও তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন। প্রায় ১০ বছর ধরে নিজ জেলায় আছেন।
টাকা আদায়ের চারটি ঘটনা
তদন্ত প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, জিল্লুর ও তাঁর সহকর্মীরা সদর থানার মৌড়াইল এলাকার মাদক ব্যবসায়ী মনু কর্মকার ও তাঁর বাবা গোপাল কর্মকারকে মাদক ব্যবসার অভিযোগে আটক করেন। এরপর তাঁদের পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় তাঁদের মারধর করা হয়। এ সময় তাঁরা মনু কর্মকারের বাসা তল্লাশি করে ১৪ হাজার ৫০০ টাকা নেন। মনু কর্মকারের স্ত্রীকে আরও ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেন। টাকা না দেওয়ায় ২০০ ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে মাদক মামলায় চালান দেওয়া হয় মনু কর্মকারকে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযানে পরিদর্শক জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে ছিলেন জুলহাস আহমেদ, সানাউল্লাহ, আনোয়ার হোসেন, জিয়াউল হক ও আমজাদ।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মনু কর্মকারের মা মনি রানী কর্মকার বলেন, ‘ওই দিন তাঁরা ঘরে থাকা নগদ টাকা, চালের টাকা, বাজারের টাকা, মনুর অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা, পূজার জন্য রাখা ঠাকুরের টাকা—সবই নিয়ে গেছে। এ ছাড়া আমার একটি ও মনুর দুটি মুঠোফোন নিয়ে গেছে।’
মনু কর্মকারের স্ত্রী লক্ষ্মী কর্মকার বলেন, ‘আমি ২৫ হাজার টাকা জোগাড় করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁরা স্বামীকে ছাড়েননি। পরে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনি।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শিমরাইলকান্দি এলাকা থেকে ৫০০ ইয়াবাসহ লেলিন ভূঁইয়া ও জেবা আক্তার নামে দুই স্বামী-স্ত্রীকে আটক করেন জেলা মাদক কর্মকর্তারা। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে মাদক বিক্রির নগদ দেড় লাখ টাকা জব্দ করা হয়। পরে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
লেলিন ভূঁইয়ার বাবা কাউসার মিয়া পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। এ কারণে সে সময় কাউসারের বাড়িতে জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়।
নিহত কাউসারের স্ত্রী ও লেলিনের মা রিনা আক্তার বলেন, ‘মাদক কার্যালয়ের লোকজন আমার ঘরের আলমারি থেকে নগদ ৩ লাখ টাকাসহ ১৭ লাখ টাকা নিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের দায়িরাপুর এলাকা থেকে রুম্মন ঠাকুর নামের এক যুবককে আটক করেন মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। পরে টাকা দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন পরিবারের লোকজন।
রুম্মন ঠাকুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘কান্দিপাড়া থেকে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেন তাঁরা। ওই ব্যবসায়ী নাকি আমার নাম তাঁদের কাছে বলেছেন। পরে তাঁরা আমাকে ধরে নিয়ে যান।’
রুম্মন অভিযোগ করেন, ‘জিল্লুর রহমানসহ বাকিরা আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। এলাকার লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে টাকার বিনিময়ে আমাকে ছাড়িয়ে আনে পরিবার।’
সম্প্রতি এক মাদক ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব থেকে কয়েক লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে মাদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ৫ এপ্রিল দক্ষিণ মৌড়াইল থেকে কামাল হোসেন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর নেতৃত্ব দেন জিল্লুর রহমান, সঙ্গে ছিলেন আবদুল মোমেন, আনোয়ার হোসেন ও জুলহাস আহমেদ। তাঁরা জোর করে কামালের স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে চাবি নেন। এ সময় আলমারিতে থাকা কামালের পরিচয়পত্র, রূপালী ব্যাংকের একটি চেকবই নিয়ে তাঁরা চলে যান। পরে কামালকে মারধর করে চেকের পাতায় (৭৯১৫৩৩২) পাঁচ লাখ টাকার অঙ্ক বসিয়ে সই নেন। চেকটি নিয়ে মোমেন ও আনোয়ার ব্যাংকে যান। কিন্তু ব্যাংক সইয়ে পার্থক্য দেখে টাকা না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। পরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কামালকে ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে তাঁরা টাকা তুলে নেয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে ৮ এপ্রিল কামালের স্ত্রী আনুকে আসামি করে মামলা এবং পরে আনুর ছেলে সাদির মিয়াকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়।
দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান প্রতিটি ঘটনার কথা স্বীকার করলেও নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন তিনি। জিল্লুর বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে এই তদন্ত প্রতিবেদন করানো হয়েছে। এসপি (পুলিশ সুপার) স্যারের আত্মসম্মানে লেগেছে তাঁদের পুলিশ সদস্য কনস্টেবল মান্নানকে আটক করে মাদকসহ চালান দিয়েছি বলে। ওই পুলিশকেও মাদক সরবরাহও করেছিল আরেক পুলিশ সদস্য।’ তিনি বলেন, ‘এসপি স্যার আমাকে দিয়ে পাঁচটি উপজেলার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন। এখন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি সব সময় মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এ কারণে কেউ আমাকে অভিযুক্ত করে থাকলে তা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, আগেও নিয়েছি।’