রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলবে।
রংপুর সিটিতে এবার ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪। গতবারের চেয়ে ভোটার বেড়েছে ২৪ হাজার। ভোট গ্রহণের কেন্দ্র ১৯৩টি। এর মধ্যে ১২৮ কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন। রংপুর সিটিতে এবার দলীয় প্রতীকে প্রথমবার ভোট হচ্ছে।
জাতীয় নির্বাচনের জটিল সব সমীকরণ সামনে রেখে আজ রংপুরে ভোটের লড়াইয়ে রয়েছে তিন প্রধান রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টি এই নির্বাচনকে ‘প্রধান বিরোধী দল’ প্রমাণের সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। হার-জিতের হিসাবের চেয়ে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের সুনাম অর্জনই মূল লক্ষ্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের। আর রংপুরে বরাবরই ‘দুর্বল ‘বিএনপি এবার ভালো কিছু করে সরকারকে একটি বার্তা দিতে চাইছে। প্রতিদ্বন্দ্বী এই তিন দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এমন মনোভাব জানা গেছে।
নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা আগেই শেষ হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুর থেকে পিকআপে করে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পুলিশি পাহারায় ব্যালট পেপার আর ব্যালট বাক্স পাঠানো হয়। ভোটের আগের দিন এখানে-সেখানে প্রার্থীদের পোস্টার ছাড়া বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা দেখা যায়নি।
ভোটার, স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে দুই ধরনের ধারণা পাওয়া যায়। এক. এই নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠুই হবে। দুই. ভোটারদের মধ্যে দলের চেয়ে ব্যক্তি সুনাম বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়েও দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন। এ কারণে তাঁকে নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আলোচনাটা বেশি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সদ্য সাবেক মেয়র সরফুদ্দীন আহম্মেদ ও বিএনপির কাওছার জামানও এই নির্বাচনে বেশ আলোচিত।
নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ধারণার পেছনে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের সংঘাত না হওয়াকে কারণ মনে করছেন স্থানীয় লোকজন। নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত নভেম্বর থেকে। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে উল্লেখ করার মতো কোনো সংঘাত-সহিংসতা হয়নি।
রিটার্নিং কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেছেন, নির্বাচনের পরিবেশ সম্পূর্ণ অনুকূলে। সুষ্ঠু নির্বাচনের সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, হার-জিত যা-ই হোক, দলের উচ্চপর্যায় থেকে সুষ্ঠু ভোটের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর স্থানীয় প্রশাসনও সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ইঙ্গিত দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিও বিশ্বাস করে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। এ কারণে দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের পর রংপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে সরকার প্রমাণ করবে, এই নির্বাচন কমিশনের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। তাঁর বিশ্বাস, এ পরীক্ষায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন উত্তীর্ণ হবে।
গত চার বছর জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। কিন্তু সারা দেশের স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অর্থাৎ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের ভোটে এর কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি তারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সমাগত। এ নির্বাচনের আগে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে সরকারের শরিক দলটি নিজেদের উজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারি দলের যে ভূমিকা, তাতে এই লক্ষ্য ভন্ডুল করার কোনো আলামত এখানে দেখছে না জাতীয় পার্টি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, জাতীয় পার্টিকে বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর একটা প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের আছে। আর অভ্যন্তরীণ জরিপ বলছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাতীয় পার্টির প্রার্থীর চেয়ে পিছিয়ে। তাই জবরদস্তি করে রংপুরে জয়ী হওয়ার চেয়ে জাতীয় পার্টিকে উজ্জীবিত রাখাকেই ভালো বিকল্প মনে করছে সরকারি দল। এর মাধ্যমে এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এটাও দেখানো যাবে। এ জন্য রংপুরে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৌড়ঝাঁপ কম দেখা গেছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘আমরা হারলেও দোষ, জিতলেও দোষ। হারলে বলে ছেড়ে দিয়েছি। আর জিতলে বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এটা তো ঠিক না।’ নির্বাচন কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোট খুব সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। এতে জনগণ যে রায় দেবে, তা মেনে নেবে আওয়ামী লীগ।
এরশাদের কারণে রংপুর জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারে আওয়ামী লীগ এর দখল নিয়েছে। গত নির্বাচনে জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনের চারটি পেয়েছে আওয়ামী লীগ। বাকি দুটি জাতীয় পার্টি। জেলার তিনটি পৌরসভার তিনটিই আওয়ামী লীগের দখলে। আটটি উপজেলার চারটি আওয়ামী লীগের, তিনটি বিএনপির, আর একটি জামায়াতে ইসলামীর। জাতীয় পার্টি একটিতেও জিততে পারেনি। ৭৬টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ৫৮টি আওয়ামী লীগের। বাকিগুলো বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের। অর্থাৎ রংপুরের নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি গত চার বছরে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে হতাশা ও গাছাড়া ভাব দেখা গেছে। দুজন নেতা বলেন, কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠ পর্যন্ত কেউ এই নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেনি।
সরকারি দলের ঢিলেঢালা ভাব দেখে জাতীয় পার্টি নেতাদের মধ্যে একধরনের স্বস্তিভাব দেখা গেছে। এরপরও দলের শীর্ষ নেতারা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এখন রংপুরে আছেন। দলের কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিবসহ দলের এক ডজন শীর্ষ নেতা ও সাংসদ সিটি এলাকার আশপাশে অবস্থান করছেন।
রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দলের ১৬ জন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। নানা জরিপ, দলীয় বিশ্লেষণ করে দলীয় নীতি-নির্ধারকেরা মনে করেছেন, দলীয় ভোটের বাইরে ব্যক্তিগত ভোটে সরফুদ্দীন আহম্মেদ এগিয়ে। তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি গতবার ১ লাখ ৬ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র হন। কিন্তু দলে তাঁর বড় কোনো পদ নেই। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও দলের মহানগর কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান গত সিটি নির্বাচনে দলের সমর্থন না পেলেও দ্বিতীয় হয়েছিলেন, ভোট পান প্রায় ৭৮ হাজার। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা রয়েছে।
আর বিএনপির মহানগর সহসভাপতি কাওছার জামান গত নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ২১ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এবার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা লাগাতার প্রচার চালিয়েছেন। প্রধান সমন্বয়ক দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাছান মাহমুদ বলেন, প্রথম দিন থেকেই বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গে বৈষম্য হয়েছে। সবার জন্য সমান মাঠ ছিল না। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে হার-জিত যাই হোক মেনে নিতে সমস্যা নেই।
অবশ্য রংপুরে প্রচারে এসে গত সোমবার ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হবে না। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সরকারকে একটা বার্তা দিতে পারি যে দেশের জনগণ তোমাদের আর চায় না।’
কয়েক দিন ধরে স্থানীয়ভাবে গুঞ্জন আছে যে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টির একরকম সমঝোতা হয়েছে। এ কারণে আওয়ামী লীগ খুব একটা তৎপর নয়। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিকেরা বলছেন, জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীর অবস্থান অনেকটাই সুস্পষ্ট। কিন্তু দলটি ৩৩টি ওয়ার্ডের মাত্র ১৫ টিতে প্রার্থী দিয়েছে। অথচ ৩৩টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী মিলে প্রার্থী হয়েছেন ৯৯ জন। বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীর সংখ্যা ১৮ জন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করে জাতীয় পার্টি সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দেয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা মেয়রের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছি, তাই সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দিইনি।’
নগরীর ১৮টি ওয়ার্ড একসময় ইউনিয়ন ছিল। গত নির্বাচনেই সেগুলো সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত পাঁচ বছরে এসব ওয়ার্ডে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। এই ১৮টি ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৭৫ হাজার।