আমি কি ভুলিতে পারি

Slider বিনোদন ও মিডিয়া

100520KKKK

 

 

 

 

আলতাফ মাহমুদ- মেঠোপথে সুরে সুরে আর গানে গানে শিস দিয়ে ঘুরে বেড়ানো অস্থির এক পাখির নাম। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই তাঁকে।

শহীদ মিনারের লাল বেদির ওপর ঝাঁকড়া চুলে গামছা দিয়ে বাঁধা হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলিয়ে খালি গলায় গান ধরেছেন সেই সুরের পাখি—
ওরে বাঙালী

তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।

লাল সিঁড়িতে বসা মানুষগুলোর চোখের অশ্রুধারা গাল বেয়ে নামছে। তাঁর ডাগর কালো চোখের পাতা দুটি বন্ধ। আবারও সেই সুরের পাখি অস্থির হয়ে প্রতিবাদী গান গেয়ে উঠেছেন—

এই ঝঞ্ঝা মোরা রুখবো

এই বন্যা মোরা রুখবো

রুখবো রুখবো রুখবোই

মায়েদের বোনেদের শিশুদের অশ্রু মুছবো

মুছবো মুছবোই।

শহীদ মিনারে বসা মানুষগুলো চোখের অশ্রু মুছে গা ঝাড়া দিয়ে প্রতিবাদী আকাঙ্ক্ষায় আপ্লুত হয়ে উঠছে। সুরের পাখির সুরের সঙ্গে তারাও মেরুদণ্ড সোজা করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস নিচ্ছে। ঠিক এভাবেই চলতে চলতে কখনো সেই সুরের পাখি তাঁর শক্ত অবস্থানের কথা বলে যাচ্ছেন। সুরের তাল আর লয়ে গেয়ে উঠছেন—

আমরা পুবে পশ্চিমে আকাশে বিদ্যুতে

উত্তর দক্ষিণ হাসিতে সংগীতে

নদীর কলতানে আমরা

সাগরে গর্জনে চলি অবিরাম

অগ্নি আখরে লিখি মোদেরই নাম

আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস।

শহীদ আলতাফ মাহমুদ (জন্ম : ২৩ ডিসেম্বর ১৯৩৩, অন্তর্ধান : ৩০ আগস্ট ১৯৭১)

কখনো আবার প্রতিবাদী শহীদ সহযাত্রীদের কথা স্মরণ করে সেই সুরের পাখি গেয়ে উঠছেন তাঁর অবিস্মরণীয় আরেকটি একুশের গান—

ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে

ঘুমিয়ে গেলো যারা

জ্বলছে স্মৃতি আলোর বুকে

ভোরের করুণ তারা।

সেই সুরের পাখির এমনই আরেকটি একুশের গান তাঁর গলায় শুনতে চেষ্টা করে যাই। সুর খুঁজে পাই না। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষাশহীদদের নিয়ে প্রথম গান ছিল সেটা। কেন জানি না কেউ তেমন একটা মনে রাখেনি সেই সুর—

মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিলো

ভাষা বাঁচাবার তরে

আজিকে স্মরিও তারে।

আক্ষেপ করা বাদ দিয়ে আবারও সেই সুরের পাখির সুর শোনার জন্য কান পেতে রাখি। আবারও হঠাত্ কানে বেজে ওঠে তাঁর গলায় তাঁর প্রিয় গান—

বল বীর—

বল উন্নত মম শির

শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রীর।

দেশ ও মানুষের জন্য কতটা প্রলয় মনে বয়ে গেলে এক সুরের পাখি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, তার ছায়া আমি দেখি আলতাফ মাহমুদের সুরের বুননে। শোক, স্তব্ধতা, অন্যায়, মিছিল আর প্ল্যাকার্ড ছাপিয়ে রাজপথে লড়াই করার জন্য সুরের আশ্রয় বুকে নিয়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ’৫২ থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে। সুর থেকে বিপ্লব করার পদক্ষেপ—তাঁর গানের সুরে সুরে প্রমাণ মেলে।

‘৫২ সাল থেকে সেই সুরের পাখির বিপ্লবী চলাচল তাঁকে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িত হওয়ার পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল। সেই সুরের পাখি হারিয়ে গিয়েছিলেন দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ের সময়ে। স্বাধীন বাংলাদেশকে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর একটি ঐশ্বরিক সৃষ্টির পুরো সুর—

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি।

সেই অস্থির সুরের পাখিকে বাংলাদেশ ভুলতে পারেনি। চোখ বন্ধ করলে

তাঁকে শহীদ মিনারে যাওয়ার পথে খুঁজে পাওয়া যায়—খালি পা, সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কাঁধে গামছা দিয়ে ঝোলানো হারমোনিয়াম নিয়ে ধীরে হেঁটে চলা রাজপথে। হয়তো আমারই পাশে। ঠিক একুশের প্রথম প্রহরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *