মরীচিকা

Slider বিচিত্র

5e37e0d848b73699a80f872265727860-5a159bf882a19

 

 

 

 

রাত তিনটার দিকে হাসানের বড় ভাই আমান হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেছেন। সকাল দশটায় তার জানাজা হয়েছে। আমানের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আর বন্ধুরা মিলে স্থানীয় কবরস্থানেই তাকে দাফন করেছেন।

আমানের সঙ্গে হাসানের যোগাযোগ নেই আজ বারো বছর। বড় বোন নাজনীন অবশ্য হাসানকে চাপড়ানোর বাকি রেখেছেন। আমান বরাবরই নমনীয়। বোনের সঙ্গে যোগাযোগ তার এখনো আছে। কিন্তু বড় ভাই আমানের ব্যাপারে হাসানের অভিমানের কাঠিন্য পাথরের চেয়েও কঠিন। হাসানের এই কাঠিন্য আর তরল হয়নি। কেউ এ প্রসঙ্গে কথা বলতেই হাসান চুপ করে থাকত। ভিন্ন প্রসঙ্গ শুরু না হওয়া পর্যন্ত তার নীরবতা আর কাটত না।
হাসানের বড় ভাই আমান সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ক্রমান্বয়ে উচ্চ পদে গেছেন। স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকতেন। হাসান কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে। ছেঁউড়িয়ায় তার একটা একতলা বাড়ি আছে। কলেজে জয়েন করার পর থেকেই মা-বাবাকে নিয়ে সেখানেই স্থায়ীভাবে আছে সে। বছরখানেক আগে ছয় মাসের ব্যবধানে মা-বাবা দুজনই ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
ফোনে বড় বোন নাজনীনের কাছ থেকে বড় ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ামাত্র হাসান আর স্থির থাকতে পারেনি। কী এক অদেখা আগুনে তার সারা শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছিল। পরিচিত এক রেন্ট এ-কার থেকে গাড়ি নিয়ে দ্রুত ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। সঙ্গে কেউ নেই। আমানের বাড়ির সামনে এসে যখন হাসান গাড়ি থেকে নামেন, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আনমনা দাঁড়িয়ে থেকে পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে বসে বাড়িটির দিকে চেয়ে থাকেন।
আমান যখন এ বাড়িতে এসে ওঠে, বাড়িটা তখন সেকেলে ধরনের দোতলা বিল্ডিং ছিল। এখন সেই বাড়ি ছয়তলা এক অত্যাধুনিক বিল্ডিং। গোপনে চোখ মুছে হাসান দৃষ্টি নত করে থ হয়ে বসে রইলেন। সারা শরীরে কেমন এক অসহ্য জ্বালাপোড়া শুরু হয়। যেটা শোক, কষ্ট, যাতনা কোনোটাই নয় যেন।
আমানের বিয়ের খবর যখন বাড়িতে এল, হাসান তখন নবীনগর হাইস্কুলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। মা-বাবা বিষয়টা সহজভাবেই নেন—ছেলে ইউনিভার্সিটি পাস করা এত বড় অফিসার। ওর বিয়াশাদি আমরা মূর্খ মানুষ আর কী বুঝমু। নিজের বিয়া নিজেই করছে। ভালো হইছে।
হাসানের অত সব নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। কারণ পরীক্ষার মাত্র আর চার দিন বাকি। এ সময় অবশ্য মা-বাবা নানান কথা বলতেন। বিভিন্ন স্মৃতি মনে করে একটু-আধটু কান্নাকাটিও করতেন। ছেলেকে পড়াতে গিয়ে কী সেই দুর্বিষহ জীবন! মায়ের জীবনে ভালো একটা শাড়ি পরার ভাগ্য হয়নি। বাবার ছেঁড়া লুঙ্গিটা সেলাই করতে করতে ছোট হয়ে যেত। বাড়ির অদূরে নদীর ঢালে জেলেরা তাদের মাছ ধরার জালটি টেকসই করার জন্য কাঁচা গাব মাড়াই করে জালে গাবের রস মাখাত। জেলেরা চলে গেলে তাদের ফেলে যাওয়া গাবের রসের ওই গর্তটায় বাবা লুঙ্গিটা ভিজিয়ে নিতেন। তারপর দুর্বল সেই লুঙ্গিটা শক্ত হয়ে যেত। চলত আরও কয়েক মাস। এমন আরও কত কথা। ছেলে তার এটা খেতে পছন্দ করে, ওটা করতে পছন্দ করে। বউমা নিশ্চয়ই বুঝবে। শিক্ষিত মেয়ে তো। ওরা আমাদের চেয়ে আরও অনেক ভালো বোঝে। একসময় এত কষ্টে শিক্ষিত করা ছেলের বউকে দেখার আকাঙ্ক্ষা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে দুজনেরই। আমান হয়তো কাউকে কিছু না বলেই হঠাৎ একদিন নতুন বউ নিয়ে বাড়ি এসে হাজির হবে। ছেলেটা যা পাগল! এই এক আশায় মা-বাবার দিন কাটতে থাকে।
পরীক্ষা শেষ হলে একদিন মা-বাবার অনেক অনুরোধে হাসান প্রায় ২৫ কেজি ওজনের দুটি বড় ব্যাগ নিয়ে ভাইয়ের বাসার উদ্দেশে রওনা হয়। পাঁচ কেজি পোলাওয়ের চাল, কাঁচা-পাকা বেশ কিছু আম, ডালিম, পেঁপে ও পেয়ারা। পুকুর থেকে ধরা প্রায় দশ কেজি মাছ।
দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে ট্রেন ধরতে হয়। ব্যাগ দুটো বহন করতে গিয়ে হাতে ফোসকা পড়ে যায়। অবশেষে কমলাপুর স্টেশনে এসে দেখা দেয় আরেক বিড়ম্বনা। কুলিরা ব্যাগ দুটো রিকশাস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে যে বিরাট অঙ্কের টাকা দাবি করে বসে, সেটা মেটানো হাসানের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। পকেটে একটি টাকাও থাকবে না আর। শেষে নিজেই একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, আরেকটা মাথায় নিয়ে এসে রিকশায় ওঠে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে বাসায় পৌঁছাতে পকেটের সব টাকাই প্রায় শেষ হয়ে যায়। এখন ভরসা, যাওয়ার পথে ভাই তো কিছু টাকা অবশ্যই দেবেন।
বাসার গেটে এসে হাসান কলবেল টিপতেই দেখল বড় ভাই আমান বাসাতেই আছে। ছোট ভাইকে দুটো ব্যাগ হাতে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমান কিছুটা অপ্রস্তুতই হলো। এদিকে বড় ভাইকে দেখে হাসানের মনে বেশ আনন্দ। মনে মনে ভাবে, যাক বাঁচা গেল, ভাবি তো আর আমাকে চেনেন না। ভাই না থাকলে কী বিপদটাই না ঘটত এখন।
প্রচণ্ড ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে হাসান মনে মনে আশা করছিল তার ভাই হয়তো নিচে নেমে এসে অন্তত একটি ব্যাগ নিয়ে দোতলায় উঠতে তাকে সহযোগিতা করবেন। তা আর হলো কই!
ব্যালকনিতে এসে আমান বলল, হাসান, ওপরে আয়।
একটি করে দুবারে হাসান ব্যাগ দুটি নিয়ে বাসায় এসে ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে রইল।
আমান এসে বলল, তোরে কি বাবা পাঠাইছে? টাকাপয়সা লাগবে নাকি?
হাসান এই আলোচনার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে স্বভাবসুলভ হাসিতে বলল, না ভাই ওই রকম কিছু না। ভাবি কই?
—হ্যাঁ, আছে।
এ সময় গেটে বেশ কিছু লোকের ডাকাডাকি শোনা গেল। ঠিক তখনই নারীকণ্ঠের ডাক শুনে আমান ভেতরের রুমে গেলে ফিসফিসিয়ে কিছু কথাবার্তা হয়।
মুহূর্তের মধ্যেই আমান ড্রয়িংয়ে ফিরে এসে হাসানকে পেছনের দিকের বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলল, বাসায় কয়েকজন গেস্ট আসছে। তারা দেশের প্রথম সারির নেতা। তুই এখানে বসে থাক। ওরা হয়তো বেশিক্ষণ থাকবে না।
হাসানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমান ভেতরে গিয়ে ধড়াম করে বারান্দায় আসা-যাওয়ার একমাত্র দরজাটি লক করে দেয়।
এটা কী কোনো নাটক-সিনেমার রিহার্সাল! এসব কী হচ্ছে? এসবের মানে কী? হাসানের গলা শুকিয়ে বুকে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়। এখন কয়েক গ্লাস পানি খেতে পারলে মনে হয় একটু স্বস্তি পাওয়া যেত। বিমূঢ়ের মতো বারান্দায় ফেলে রাখা একটা জীর্ণ চেয়ারে বসে পড়ল হাসান। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে টের পেল তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা কোথায় যেন উবে গেছে। বারান্দার এক কোণে কিছু হাঁড়ি, বাসন, পেয়ালা জীর্ণ চট দিয়ে ঢাকা। পাশেই ফেলে রাখা প্লাস্টিকের এই জীর্ণ চেয়ারটি।
পড়ন্ত বিকেল। দিনের এই আলোতেও স্তূপের ভেতর থেকে বড় বড় মশা বের হয়ে হাসানের হাত-পা-গাল-ঘাড়ে নিরন্তর কামড়াতে লাগল। কোনোভাবেই মশার এ উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। হাসান একবার চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়ায়, আবার নিচে নামে। এপাশ-ওপাশ করে একসময় তার মনে হলো, এখন জোর করে কিছুক্ষণ কাঁদতে পারলে মনে হয় কষ্টটা লাঘব হতো। বাসায় অতিথিদের কথাবার্তা, হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে পেয়ালা আর চামচের আওয়াজ। ধেয়ে আসছে সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ।
ভাইকে ডাকতে চেষ্টা করতে গিয়েও গলা আটকে যাচ্ছে। সবার এত আশার, এত শ্রদ্ধার একমাত্র বড় ভাই তার। মনে মনে সে ভাবে, কী অসহ্য গরম। তৃষ্ণায় তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে, ক্ষুধায় চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, ভাই কেন বুঝতে পারছে না। এভাবেই প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর অতিথিরা বিদায় নেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মশার অত্যাচার তখন আরও কয়েক গুণ বাড়লেও হাসান নিথর হয়ে চেয়ারটায় বসে রইল। শরীরে কোনো অনুভূতিই যেন কাজ করছে না আর। অতিথিরা গেট পার হয়ে গেলে আমান এসে বারান্দার দরজা খোলে।
হাসানকে ভেতরে ডেকে নিয়ে প্রথমেই বলল, মা-বাবার খরচের টাকা লাগবে, তাই তো?
হাসান দৃষ্টি নত করে বলল, না ভাই টাকা লাগবে না।
—অন্তত অল্প কিছু টাকা নিয়ে যা।
—না, টাকা লাগবে না।

ac74c76285c7369feb7c3b355509fa5d-5a159bf87cff0

আমানকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাসান সোজা বাসা থেকে বের হয়ে গেল। মোড়ের রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুটি পরোটা আর কয়েক গ্লাস পানি খায় সে। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে কমলাপুর স্টেশনে এসে বসে রইল ট্রেনের অপেক্ষায়।
স্বপ্নের এই শহরে বড় ভাইয়ের বাসায় ঘটে যাওয়া সেদিনের ঘটনাটি মন থেকে মুছে ফেলতে হাসান অনেক চেষ্টা করেছে। এখনো করছে। মনে মনে ভাবে, ভুলত্রুটি নিয়েই মানুষের জীবন। চলতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কত কিছুই তো হয়। এসব মনে গেঁথে রাখলে কি আর চলে? তবে ভাই-ভাবি বলে নয়, এ ঘটনাই যেন এক আতঙ্ক। ব্যস্ততার মাঝে, কখনো অবসরে ওই দৃশ্যটা মনে পড়তেই অস্থির হয়ে পড়ে সে। কেউ বড় ভাইয়ের প্রসঙ্গে কিছু বললেই তার চোখেমুখে নেমে আসে পাথরের মতো কঠিন এক নীরবতা। তবে সেদিনের পর থেকে আমান নামে যে তার কেউ একজন এ সংসারে আছে, সেই অধ্যায়টাই মন থেকে মুছে গেল যেন। মা-বাবাসহ সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে সেদিন থেকেই শুরু হলো তার অন্য রকম জীবনসংগ্রাম। এক অন্য রকম পথচলা। সংসারে কে আর কার জন্য আটকে থাকে। জীবনের প্রয়োজনেই জীবন আপন পথ তৈরি করে নেয়।
মাসখানেক পর একদিন বড় বোন নাজনীন বাড়িতে আসেন। মা-বাবার সঙ্গে নানান কথাবার্তা শেষে একসময় সে বলেন, আমানের বিয়ের পরপরই একদিন ওর বাসায় যাই। বউকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসতে বলি। আমান আমার কথায় পাত্তাই দিল না। আর বাড়িতে এসে মা-বাবাকে দেখে যাওয়ার কথাটা তো বলতেই পারলাম না। আমার ভাই। আমার বাসায় থেকে লেখাপড়া করল। আমারই গর্ব। তিন বাটি তরকারি নিয়ে গেছি। তরকারির ব্যাগটা নিয়ে আমান যখন ভেতরে গেল, আমারে দেখায়েই ব্যাগটা বিনে ফেলে দেয়। আমারে শোনায়ে মেয়েটা বলে, জাদু-টোনা করতে আইছে। আমার সামনেও এল না। ভালো-মন্দ জিজ্ঞেসও করল না।
এসব শুনে মা-বাবার নীরবতাও বেড়ে যায়। এরপর থেকে আমান প্রসঙ্গে কথাবার্তা আর হয়ই না। কেউ এ নিয়ে কিছু বলতেই বাবা সব সময় নীরবই থাকেন। মা কখনো কখনো জড়ানো গলায় বলেন, আমার পোলা বড় ঘরের মেয়ে বিয়া কইরা বদলাইছে। তবে হাসান তার ভাইয়ের বাসার অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি। জীবনে আর বলবে বলে মনেও হয় না।
বাড়িতে হাসানের এক আপন ভাই ছিল। আজ নেই। মহাকালের হিমঘরে মিশে গেছে। ছোটবেলার আদর-সোহাগে মাখামাখি ওই দিনগুলো। মেলা থেকে কিছু শখের জিনিস কিনবে বলে এক বছর চেষ্টা করে কিছু টাকা জমিয়েছিল হাসান। আর সপ্তাহখানেক পরই মেলা শুরু হবে। এমন সময় বড় ভাই আমানের মাস্টার্স পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে তার টাকার প্রয়োজন হলে বাবা দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি টের পেয়ে হাসান সেদিন তার এত শখ করে জমানো টাকাগুলো হাসিমুখে ভাইকে দিয়ে দেয়। এমন অনেক কথাই তখন মনে পড়ছিল তার।
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে একইভাবে বসে থাকতে দেখে রেস্টুরেন্টের মালিক আলম কাছে এসে বলেন, ভাইয়ের মনটা ভালো না বোধ হয়।
—জি ভাই। আমার ভাই মারা গেছে।
—এই বাড়ির আমান সাব আপনের ভাই?
—জি।
—দেখেই চিনতে পারছি। ওনার সঙ্গে আপনার চেহারার মিল আছে।
—জি, আপনাকেও আমার স্মরণে আছে। অনেক বছর আগে আপনার এই দোকান থেকে দুটি পরোটা খেয়েছিলাম। টাকা ছিল না, তাই হাতের ঘড়িটা…।
—ও আচ্ছা, জি মনে পড়ছে। আপনার ঘড়িটা আছে। যত্ন করে রাখছি। মনে করে নিয়ে যাবেন ভাই।
আলম পাশের চেয়ারে বসে বলল, আপনার ভাই অনেক কষ্ট করে মারা গেছে।
কথাটা শুনেই হাসান শিউরে ওঠে।
—কষ্ট, কষ্ট কেন?
—ও মা, কী বলেন! আপনার ভাই, আপনি জানেন না?
—না।
—আরে ধুর ভাই।
বলেই রেস্টুরেন্টের মালিক আলম সাহেব উঠে যেতে উদ্যত হলে হাসান বলল, না ভাই। আসলেই জানি না। আপনি বসুন।
—আপনার ভাই প্রায় বছরখানেক প্যারালাইজড ছিল।
—বলেন কি?
—ভাই। আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ। লেখাপড়া তেমন জানা নাই। আজ ৪২ বছর চলে এই দোকানটা নিয়ে আছি। এই দুইটা চোখে কত জীবনের উত্থানপতন দেখছি। অনেক বিদ্বান, মতবান মানুষ ধ্বংসের অতলে ডুবে যায়। কারণ, জীবনের নিয়ম বুঝতে তারা ভুল করে। আপন গতিতে চলে এ নিয়ম। গায়ের জোরে ওলটানো যায় না।
একটা হালকা নিশ্বাস ছেড়ে আলম সাহেব বলে যান, বাবাকে হারিয়েছি সেই ছোটবেলায়। তারপর থেকে এই দোকানটায়। সকাল ছয়টা থেকে রাত দশটা। কখনো এগারোটা। অসুস্থ মা। প্রায়ই এসে বসে থাকতেন। আর বলতেন, বাবা সারা দিন তোকে দেখি না। আমার কী আর শান্তি লাগে রে বাবা। অসুস্থ শরীরে মা আর কত বসে থাকবেন। তাই পাশেই স্টোর রুমটা খালি করে সুন্দর করে বিছানা করি। এসি লাগিয়ে দিই। মা এখানে ঘুমাতেন। জেগে উঠে আমার দিকে চেয়ে থাকতেন। মায়ের পছন্দমতো নানান খাবার। যখন যা ভালো লাগে। এগারো বছর হতে চলেছে মা নেই। এই দেখেন রুমটা আজও এভাবেই রেখেছি। মাঝে মাঝে এই বিছানাটায় বিশ্রাম করি। মায়ের ঘ্রাণ পাই।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে অশ্রুভেজা চোখে আলম সাহেব বলেন, কী আর বলব ভাই, মায়ের ওই ঘ্রাণ যার জীবনে ধরা দেয়নি, সে সম্পদের পাহাড় গড়লেই কি আর বিদ্যার জাহাজ হলেই বা কী…।
হাসান মুগ্ধ চোখে আলম সাহেবের মুখের দিকে চেয়েই থাকে কেবল। অনেক দিন আগের কী একটা স্মৃতি মনে পড়ে হাসানের চোখ দুটি ভিজে এল। আলম সাহেব বলেই যান, আপনের ভাইয়ের জীবনটা…আমার চোখের সামনেই সব। কী আর বলব ভাই। আত্মীয়স্বজন কারও সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল না। এ কথা নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে আপনার ভাবি, এমন সুন্দরী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। তার ছোটবেলাতেই বাবা-মায়ে ছাড়াছাড়ি। আপনার ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার বছরখানেক আগে তার বাবা কানাডায় চলে যায়। যাওয়ার সময় এই বাড়িটা লিখে দিয়ে যায় মেয়ের নামে। তারপর থেকেই মেয়েটা ধীরে ধীরে ওই জগতে ঢুকে পড়ে। তখন থেকেই এ বাড়িতে বড় বড় দাপটশালী লোকের আনাগোনা শুরু হয়। বেশ কৌশলের ভেতর দিয়ে চলত সে। টুঁ শব্দটি করার সাহস করত না কেউ। চোখে দেখছি সব। এসবের মাঝেই চলতে থাকে আপনার ভাইয়ের জীবন। দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করার পর হাসপাতাল থেকে ফিরে পরের দিন আমার এখানে আসে। কয়েক ঘণ্টা বসা ছিল ওই চেয়ারটায়। আমাকে কাছে বসিয়ে বলল জীবনের সব কথা। আমি তো ব্যস্ত মানুষ ভাই। তারপরও ধৈর্য নিয়ে শুনেছি। একটা সন্তানের আশা ছিল খুব। মনে মনে এ আশাও ছিল সন্তান কোলে এলে সব ঠিক হয়ে আসবে। হলো আর কই। জানি না আমার কাছে ওসব কথা কেনই বা বললেন। এখন বলেন, আপনে এখানে কি কাজে আসছেন?
—ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। এখানে কেন আসছি জানি না, ভাই।
—না জানাই ভালো। আপনার বিষয়ে বলছিলেন উনি। জানি, আপনি ভদ্রলোক। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষক আপনি। মান বাঁচাইতে চাইলে এখান থেকে চলে যান। এ বাড়িতে ঢোকার চিন্তাও কইরেন না।
—না ভাই। এ বাড়িতে যাওয়ার চিন্তা শুরু থেকেই আমার নাই। এখানে কাউকে চিনি না তো।
বসা থেকে উঠে হাসান বলল, ভাই আজ আসি। ভালো থাকবেন।
গাড়িতে উঠে ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়। পড়ন্ত রোদ। বড় বড় বিল্ডিংয়ের ছায়া ক্রমে দীর্ঘ হয়। কয়েকটা উত্তপ্ত নিশ্বাসে হঠাৎ হাসানের শরীরটা কাঁটা দিয়ে কেমন ভয় করতে লাগল। অনুভূতির সর্বত্র এক অগ্নিসংকেত তাকে বজ্র ঘোষণায় জানিয়ে দিল, হাসান, পৃথিবীতে আজ তুমি বড় একা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *