কথায় কথায় ব্যবহার হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক কমছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

Slider সারাবিশ্ব
76122_x2       কথায় কথায় ব্যবহার হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। সামান্য জ্বর হলেও আশ্রয় নেয়া হচ্ছে এর। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকিতে পড়ছে রোগীরা। পাড়া-মহল্লার ফার্মেসিগুলো শুধু অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই ক্ষতিসাধন করেন না, বেশির ভাগ সময় তারা অ্যান্টিবায়োটিকের সম্পূর্ণ কোর্স না দিয়ে দুই-এক ডোজ দেন। যেটা রোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাইরের দুনিয়া রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ তো দূরের কথা, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির কোনো নিয়ম নেই বলেও তারা উল্লেখ করেন। অথচ আমাদের দেশে এই ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ ব্যাপক উদাসীন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমাদের হাতে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সংক্রামক রোগ বেশি, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনও বেশি। কিন্তু বিশ্বে যত ওষুধ তৈরি হচ্ছে তার মাত্র নয় ভাগ কেনে উন্নয়নশীল দেশগুলো। উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টি এখন অসংক্রামক ব্যাধির দিকে। উন্নত দেশগুলো নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। কাজেই বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, একদিকে যেমন আরো নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হওয়া প্রয়োজন তেমনি একই সঙ্গে সরকার ও সাধারণ মানুষের উচিত অ্যান্টিবায়োটিকের সুচিন্তিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে শুধু রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি, সেবন বা গ্রহণ করা, ব্যবস্থাপত্রের উল্লিখিত সময় ও নির্দেশনা মেনে চলা, শারীরিক সুস্থতা অনুভব করলেও অ্যান্টিবায়োটিক পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করা, কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া, সময়মতো সব টিকা গ্রহণের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী এবং ওষুধের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে অচিরেই খুব সাধারণ সংক্রমণ, সামান্য কাটাছেঁড়া থেকে মৃত্যু হবে মানুষের। বিশ্বের ১১৪টি দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর প্রতিবেদন দেয়। সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট, ভাইরাস অথবা ছত্রাকজনিত কারণে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার ঝুঁকির বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাধারণ স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী মহাপরিচালক ড. কেইজি ফুকুদা। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী) জীবাণুর মাধ্যমে বছরে মারা যাচ্ছে ৭০ হাজার লোক। আর ২০৫০ সাল থেকে বছরে এই সংখ্যা হবে এক কোটি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সজনিত মৃত্যু কমাতে হলে অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এই ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে ব্যবহৃত জীবন রক্ষাকারী একটি ওষুধ হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। তবে এ জন্য যথাযথ মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন থেকে কম মাত্রায়, অযৌক্তিকভাবে ও মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে জীবাণু ক্রমান্বয়ে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র মনিটরিং, অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রয় রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ, ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কাউন্সেলিং করা। মানসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনে কঠোরভাবে জিএমপি অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ এবং এর যৌক্তিক ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, পশু সম্পদ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য পেশাজীবী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর একযোগে কাজ করতে হবে। সূত্র জানায়, ইকোনমিস অ্যান্ড পলিসির (সিডিডিইপি) সহযোগিতায় বাংলাদেশে গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স পার্টনারশিপ (জিএআরপি)-২০১৬ গঠন করা হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জিএআরপির কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। জিএআরপি বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০টি দেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার ক্ষেত্রে কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের ধরন অনুযায়ী কোর্স ভিন্ন ভিন্ন হয়। এটি কোর্স অনুযায়ী না খেলে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে যেসব জীবাণু থাকে সেগুলো মরে না। এগুলো পরে রোগীর শরীর থেকে বিভিন্ন উপায়ে অন্যের শরীরে প্রবেশ করে। এসব জীবাণুতে অন্য কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে তখন একই অ্যান্টিবায়োটিকে আর ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোনো কাজ করে না। তখন আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়, যেটি মূত্রের সিএস পরীক্ষার পরই দিতে হয়।
এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসক, রোগী ও ফামের্সিগুলোকে সতর্ক হতে হবে। আবার মানুষ ইচ্ছামতো এটি ব্যবহার করে, এটিও প্রতিরোধ করতে হবে। সামান্য অসুখে মানুষ ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক যাতে কিনে খেতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রাম্য চিকিৎসকেরা রোগীদের যথেচ্ছভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন, এই ক্ষেত্রে তাদেরকেও সতর্ক করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহারের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বেশি হচ্ছে। এ কারণে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে রেজিস্ট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে। এর প্রভাবে মৃত্যুর ঘটনাও বাড়বে। বাড়বে স্বাস্থ্যসেবা খরচ। তিনি বলেন, সাতদিনের কোর্স সাতদিনই খেতে হবে। কমও নয়, বেশিও নয়। না হলে রোগটি পুনরায় ফিরে আসতে পারে বা বিভিন্ন ইনফেকশন হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *