ঠাকুরগাঁওয়ে কমছে আশ্রয়স্থল, হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মাছ

Slider রংপুর

received_1329144837154567

এস. এম. মনিরুজ্জামান মিলন, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ আধুনিকতার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। লক্ষ্য আমাদের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। তবে সেটা কি আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করে?

আমরা হয়ে উঠছি আধুনিক। বাপ-দাদার পুকুর, খাল-বিল ভরাট করে গ্রামে-বন্দরে গড়ে তুলছি বিশাল বিশাল অট্টালিকা। অবৈধভাবে কিংবা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভরাট করছি নদী, জলাশয়। এরকম আধুনিকতার মূল্যটা কি যেখানে সমাজ, পরিবেশের কথা না ভেবে নিজেরটা ভাবা হয়?

উত্তরের প্রাণোচ্ছল শহর ঠাকুরগাঁওয়েও আজ লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ভরাট হচ্ছে নদী, পুকুর-জলাশয়, খাল-বিল। কমে যাচ্ছে মাছের বিভিন্ন ধরণের আশ্রয়স্থল।

আর এসব নদী, পুকুর-জলাশয়, খাল-বিল ভরাটের ফলে ঠাকুরগাঁওয়ে কমছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এসব মাছের মধ্যে দেশীয় প্রজাতির মাছের সংখ্যাই বেশি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ডা. মু. নিজামউদ্দিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ঠাকুরগাঁওয়ে একসময় বিছিন্ন দেশী প্রজাতির মাছের অনেক প্রাচুর্য ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে হারিয়ে গিয়েছে অনেক প্রজাতির মাছ। IUCN জরিপে জানা যায়, ঠাকুরগাঁওয়ে ৫৪ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। তবে ১৭ প্রজাতির মাছকে সংরক্ষণ ও চাষাবাদের মাধ্যমে বিলুপ্তির হাত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে পৌরসভার সালন্দর ইউনিয়নে মহাসড়কের পাশে বেশ নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়। এখানে পুরো জেলার মাছের খবরাখবর যেমন পাওয়া যায় তেমনি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষাবাদ, পরিচর্যা ও সুলভ মূল্যে মাছের রেণু ও পোনা বিক্রয় করা হয় এখানে। শুধুমাত্র এখানেই উৎপাদিত হয় ২৬৫৫ মেট্রিক টন মাছ।

চাষাবাদ ও পরিচর্যার জন্য এখানে রয়েছে আটটি দিঘী। গ্রামের মানুষ স্থানটিকে আটডিগী বলতে বলতে জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের নামই পড়ে গেছে ‘আটডিগী’। এখানে তেলাপিয়া, কৈ, শিং, মাগুর, পাঙ্গাশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ করা হয়। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি পঞ্চগড় জেলা থেকেও মৎস্যচাষীরা এখানে আসেন মাছের রেণু, পোনা সংগ্রহের জন্য।

ঠাকুরগাঁও মোট চাহিদার পরিমাণ ২২১০০ মেট্রিক টন আর উৎপাদনের পরিমাণ ২১৬৫৫ মেট্রিক টন মাছ। ঠাকুরগাঁওয়ের মৎস্যালয়গুলোতে বালুমাটির পরিমাণ বেশি থাকায় ঠাকুরগাঁওয়ে মৎস্য উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম। তবে বাণিজ্যিকভাবে যারা মাছের চাষ করেন, তারা পুকুর, খাল-বিলে বালুমাটির পরিমাণ কমিয়ে, পলিথিনের আস্তরণ বিছিয়ে তার ওপর কিছুটা বেলে-দো’আশ মাটির আস্তরণ করে মাছের চাষাবাদ করেন।

পুরো এলাকা ঘুরে দেখতে দেখতে কথা হয় মাছ সংরক্ষণ, পরিচর্যা, বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বিলুপ্ত ঠেকাতে গৃহিত বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা। তিনি জানান, জনসচেতনতা এবং মাছের উৎপাদন বাড়াতে নিয়মিতভাবে এই কার্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে সভা, কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এসব জলাধারগুলোতে পানিধারণ ক্ষমতা বাড়াতে পারলে মাছের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব।

পরিকল্পনার আলোকে আমরা যদি আমাদের চারপাশে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের আশ্রয়স্থলগুলো টিকিয়ে রাখতে পারি তাহলে বিলুপ্তপ্রায় বিছিন্ন প্রজাতির মাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাচাঁনো সম্ভব হবে। এরজন্য মৎস আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঠাকুরগাঁওয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

একসময় আমাদের বলা হতো ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। কিন্তু এগুলো এখন শুধুই প্রবাদবাক্য। নিজেদের ভুলে আজ এই প্রবাদবাক্য সেঁটে রয়েছে শুধু বইয়ের ভাঁজে। নিজেদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মাছের এসব আশ্রয়স্থল ধ্বংস না করে মাছের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে এসব নদী, পুকুর-জলাশয়, খাল-বিল; এই হোক আমাদের অঙ্গিকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *