নাটোরে গড়ে উঠছে সজিনা গ্রাম

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি খুলনা

2017-04-26_2_497794

পুষ্টি ও ওষুধী গুণাগুণের কারণে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত সজিনার আবাদ বেড়েছে নাটোরে। জেলার ১৬৪টি কৃষি ব্লকের প্রত্যেকটিতে গড়ে তোলা হয়েছে সজিনা গ্রাম। বৃদ্ধি পাচ্ছে সজিনা গাছের সংখ্যা ও এর উৎপাদন। প্রচলিত কার্টিং পদ্ধতি ছাড়াও চারা রোপণের মাধ্যমে সজিনা চাষের পরিধি বেড়েছে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন সজিনার পুষ্টিগুণ ব্যতিক্রমধর্মী। আমিষের অনুপাত বিবেচনায় সজিনা গাছকেই পৃথিবীর সেরা গাছ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর পাতায় ৩৮ রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডসহ ৩৮ শতাংশ আমিষ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সজিনার পাতা পুষ্টিগুণের আঁধার। পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সজিনা পাতায় কমলা লেবুর সাতগুণ ভিটামিন সি, দুধের চারগুণ ক্যালসিয়াম এবং দুইগুণ আমিষ, গাজরের চারগুণ ভিটামিন ‘এ’, কলার তিনগুণ পটাসিয়াম, পালংশাকের তিনগুণ লৌহ বিদ্যমান। পুষ্টি ও ওষুধী গুণ বিবেচনায় এই গাছকে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ বলা হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় এটি একটি মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ।
ভারতীয় আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্র মতে সজিনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ প্রতিরোধ করে এবং আধুনিক বিজ্ঞানও এই ধারণাকে সমর্থন করে। সজিনার কচি পড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সজিনার বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ওষুধী গুণ আছে। সজিনা বাতজ্বর চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। পোকার কামড়ে এন্টিসেপটিক হিসেবে সজিনা পাতার রস ব্যবহার হয়। মাথা ব্যথায় সজিনার কচিপাতা কপালের দুই পাশে ঘষলে ব্যথা উপশম হয়। সজিনা গ্যাস্টিক রোগের বায়ুনাশক হিসেবে কাজ করে। পাতার রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়। শ্বেতীরোগ, টাইফয়েড জ্বর, প্যারালাইসিস এবং লিভারের রোগে সজিনার রস উপকার। ক্ষতস্থান সারার জন্য সজিনা পাতার পেষ্ট কার্যকরি। খাদ্যাভাসে সজিনা গাছের পাতা বা সজিনা থাকলে চোখের ছানি পড়া রোগ কম হয়। সজিনা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা এবং মাইগ্রেন চিকিৎসায় সজিনা ভাল কাজ করে। ভারত, চীনসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে সজিনা পাতার পাউডার দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ পীড়িত অনাহার ও অপুষ্টি শিকার মৃতপ্রায় রোগাক্রান্ত শিশুদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য সজিনার পাতা ও পাতার গোড়া খাওয়ানোর কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
সজিনার মূল ফলন শেষে বৈশাখ–জ্যৈষ্ঠ মাসে গাছ থেকে ডাল সংগ্রহ করে কার্টিং রোপণ করা হয়। বসতবাড়ি, রাস্তার ধারসহ যে কোন স্থানের মাটিতে ৩ মিটার দূরত্বে কার্টিং রোপন করা যায়। রোপনকালে গোবর সার এবং দ্রুত শিকড় গজানোর জন্য সামান্য ফরফরাস সার ও ছাই ব্যবহার করা উত্তম।
সাম্প্রতিক সময়ে পি কে এম জাতের বীজ থেকে সজিনার চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। ৩ বছর মেয়াদী বিশেষ কর্মসূচির আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বারোমাসি সজিনার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনায় দেশের ৪০টি হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে ৩০ লাখ চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারে উৎপাদিত চারা নাটোর ছাড়াও সিরাজগঞ্জ কৃষি বিভাগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কৃষকরা রোপন করবেন বলে জানিয়েছেন নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ–পরিচালক স ম মেফতাহুল বারি। তিনি বলেন, চারার সজিনা গাছের উচ্চতা ১ মিটার হলে ডগা কেটে এর আকৃতি ঝোপালো করা হলে ফলন বৃদ্ধি পায় এবং সজিনা সংগ্রহে সুবিধা হয়। এসব গাছে বারোমাসই ফলন পাওয়া যায়।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ২০৬ হেক্টর আবাদি এলাকা থেকে ৩ হাজার ৬৯৫ টন সজিনা উৎপাদন হয়েছে। হেক্টর প্রতি উৎপাদন ১৭.৯৪ টন। বিগত বছরগুলোর চেয়ে উৎপাদন এলাকা, ফলন ও একক উৎপাদন অনেক বেড়েছে। বিগত বছরে ১৫৮ হেক্টর থেকে ২ হাজার ৫৬৮ টন হিসেবে একক প্রতি উৎপাদন ছিল ১৬.২৫ টন। তার আগের বছর ১২৮ হেক্টরে ১ হাজার ৯২০ টন মোট উৎপাদন অর্থাৎ হেক্টর প্রতি ১৫ টন সজিনা উৎপাদন হয়েছিল।
গত বছর প্রচলিত পদ্ধতিতে সজিনার চাষাবাদ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমে কার্টিং রোপন ছাড়াও চারাগাছ রোপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে নাটোরের কৃষি বিভাগ। কৃষি বিভাগ জেলার ১৬৪টি কৃষি ব্লকে ১৬৪টি গ্রাম নির্বাচন করে ২৩ হাজার ১০৮ জন কৃষকের মাধ্যমে ৫৬ হাজার ৮৭২টি সজিনার কার্টিং ও চারা রোপন করেন। গড়ে তোলা হয় সজিনা গ্রাম।
এসব সজিনা গ্রামে সজিনা গাছের সংখ্যা চোখে পড়ার মত। বসতবাড়ি ছাড়াও রাস্তার দুধারে সজিনার গাছ চোখে পড়ে। নাটোর সদর উপজেলার রুয়েরভাগ এলাকার কৃষক মজিবর রহমান তার বসতবাড়ি ছাড়াও বাড়ি সংলগ্ন রুয়েরভাগ–বালিয়াডাঙ্গা সড়কের দুধারে প্রায় ১০০টি সজিনার কার্টিং ও চারা গত মৌসুমে রোপণ করেন।

চন্দ্রকোলা কৃষি ব্লকের উপ–সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আতিকুর রহমান বলেন, একটি গাছ থেকে দুই মণ সজিনা সংগ্রহ করা সম্ভব। সজিনা চাষ বৃদ্ধি পাওয়াতে বাজারে বিক্রির মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক সংগতিও বেড়েছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া কৃষি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা জানান, মহিষভাঙ্গা গ্রাম সজিনার আবাদে শীর্ষে। এই গ্রামের সাহাবুদ্দিন পাঠানের বাড়ির আঙ্গিনা জুড়ে ৫০ সজিনার গাছ। তিনি এবার বাড়িতে খেয়ে ও আত্মীয়–স্বজনদের বিতরণ করার পরও অন্তত ২৫ মণ সজিনা বিক্রি করেছেন।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. সাইফুল আলম জানান, চলতি মৌসুমে উপজেলার নবীন কৃষ্ণপুর ও কুড়িপাড়ার সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা স্কুলের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে ছাড়াও আশ্রয়ন প্রকল্পগুলোতে সজিনার চারা রোপনের বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ বলেন, এবার উপজেলার ২৩টি ব্লকে বিদ্যমান সজিনা গ্রামের পাশাপাশি নতুন সজিনা গ্রাম তৈরি করা হবে। চারা ও কার্টিং রোপণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্লক কর্মকর্তা ছাড়াও কৃষি কলেজসমূহের ইন্টার্নীরত শিক্ষার্থীরা কর্মসূচিতে সহযোগিতা করবে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ চলতি মৌসুমে চারা ও কার্টিং মিলিয়ে মোট ২৫ হাজার সজিনা গাছ রোপণ করবে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ–পরিচালক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, নাটোরে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ সজিনার আবাদ ও উৎপাদন ক্রমশঃ বাড়ছে। কাটিং ছাড়াও চারা রোপণের মাধ্যমে অধিক সুফল প্রাপ্তির চেষ্টা চলছে। সজিনা সকল উপাদানের যথাযথ ও বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে সুফল প্রাপ্তির পরিধি আরো বাড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *