যেভাবে হত্যা, গুম

Slider বাংলার মুখোমুখি

49466_f3

 

ঢাকা; আদালতের কাছে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়া আসামিদের তথ্যমতে বেরিয়ে আসে সাতজন অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা ও গুম করার লোমহর্ষক চিত্র। নাসিক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গে অপর কাউন্সিলর নুর হোসেনের বিরোধের জের ধরে নুর হোসেন নজরুলকে শায়েস্তা করতে র‌্যাবকে বেছে নেয়। নুর হোসেনের সঙ্গে র‌্যাব-১১এর মেজর আরিফ হোসেনের (অব) সখ্য ছিল। ২০১৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি আরিফ হোসেন র‌্যাব-১১ তে যোগদান করেন। বিভিন্ন সময় আরিফ হোসেন নুর হোসেনের আস্তানায় গিয়েছেন। নুর হোসেনও আরিফের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে র‌্যাব অফিসে গিয়েছেন। একই বছরের ৩রা নভেম্বর র‌্যাব-১১তে সিও হিসেবে যোগদান করে লে. কর্নেল (অব) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ। একসময় নুর হোসেনের সঙ্গে তারেক সাঈদকে পরিচয় করিয়ে দেয় আরিফ হোসেন। এদিকে নুর হোসেনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সুবিধা নেয়া আরিফ হোসেনের মাধ্যমেই নজরুলকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়া হয়। আরিফ হোসেনের প্ল্যানমতে বিষয়টি কোম্পানি অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদকে জানায় আরিফ হোসেন। সেই মতে, ২০১৪ সালের মার্চ মাসে আদমজীনগরে অবস্থিত র‌্যাব-১১ এর হেডকোয়ার্টারে অফিসার্সদের কনফারেন্স হয়। ওই কনফারেন্সে সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ কাউন্সিলর নজরুলকে টার্গেট হিসেবে দেন আরিফ হোসেনকে। এবং নজরুলকে ধরার জন্য তারেক সাঈদ নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. কমান্ডার রানা (অব)কে নির্দেশ দেন আরিফকে সাহায্য করার জন্য। এরপর আরিফ ও রানা মিলে একাধিকবার নজরুলকে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়। ওই সময় নজরুলকে ধরার জন্য আরিফ ও রানা সঠিকভাবে তথ্য পাচ্ছিলো না। তখন তারা নজরুলের প্রতিপক্ষ অপর কাউন্সিলর নূর হোসেনকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। ২০১৪ সালের ২৭শে এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে নূর হোসেন ফোন করে আরিফকে বলে যে নজরুল আজকে নারায়ণগঞ্জ কোর্টে হাজিরা দিতে এসেছে। তখন তাৎক্ষণিকভাবেই আরিফ ওই সংবাদটি লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে জানান। তারেক সাঈদ তখনই আরিফকে ও রানাকে নজরুলকে ধরার জন্য অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। নির্দেশ মতে আরিফ আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টার সময় অভিযানের বিষয়ে রানার সঙ্গে কথা বলেন এবং আরিফ তার নীল রঙের মাইক্রোবাস নিয়ে তার টিমসহ কোর্টের উদ্দেশ্যে বের হয়। আরিফ তার টিমের সদস্য হাবিলদার এমদাদ, এসআই পুর্নেন্দু বালা, নায়েক দেলোয়ার (ড্রাইভার), নায়েক বেলাল, নায়েক হীরা, নায়েক নাজিম, সিপাহী তৈয়ব, সৈনিক আলীম, সৈনিক আলামিন, সৈনিক মহিউদ্দিন, কনস্টেবল শিহাবকে নিয়ে একত্রে নীল রঙের মাইক্রোবাসযোগে বের হয়। আনুমানিক বেলা ১১টার সময় তারা কোর্টের বাইরের গেটে এসে উপস্থিত হন। ওই সময় আরিফ তার টিমের সদস্য হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল, সিপাহী তৈয়বকে কোর্টের ভেতরে পাঠায় নজরুলের গতিবিধি নজরদারি করার জন্য। আর আরিফগংরা কোর্টের বাইরে রাস্তার পশ্চিম পাশে অপেক্ষা করে। বেলা সোয়া ১১টার দিকে একটি সিলভার কালারের মাইক্রোবাসে করে রানার টিমের ৭/৮ জন সদস্য নিয়ে আরিফের সঙ্গে যোগ দেন। ওই সময় রানা মাইক্রোবাসে ছিলেন না। আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রানা নিজের গাড়িতে করে এসে গাড়ি ছেড়ে দেন এবং আরিফের মাইক্রোতে উঠে আরিফের পাশের সিটে বসেন। ওই সময় আরিফ রানাকে জানায়, নজরুলের সঙ্গে তার ১৫/১৬ জন সহযোগী আছে। রানা সিনিয়র হওয়ার কারণে তখন তিনি অপারেশন কমান্ডার হয়ে যান এবং তিনি যেভাবে প্ল্যান করেন সেভাবেই কাজ হয়। ওই সময় রানা প্ল্যান করেন যে, রুটিন পেট্রোল টিমের সদস্যদের দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়াম এলাকায় সিটি করপোরেশনের গেটের কাছে ফাঁকা এলাকায় নজরুলের গাড়িটি থামাবেন। আনুমানিক ১টার দিকে নজরুল একটি সাদা প্রাইভেটকারে করে কোর্ট থেকে বের হয়ে সাইনবোর্ডের দিকে যায়। তখন আরিফ ও রানা তাদের মাইক্রোবাস ২টি নিয়ে নজরুলের গাড়ির পিছু পিছু যায়। রানা ওই সময় নজরুলের গাড়ির বর্ণনা দিয়ে পেট্রোল টিমকে ওই গাড়িটি থামাতে বলে। আনুমানিক দেড়টার দিকে পেট্রোল টিম চেকপোস্ট বসিয়ে সিটি করপোরেশনের গেটের কাছে নজরুলের গাড়িটি থামায়। তখন আরিফ ও রানা পেছন থেকে গিয়ে নজরুলের গাড়ি থেকে নজরুলসহ ৫ জনকে বের করে আরিফের মাইক্রোবাসে তোলে। ওই সময় তাদের পেছনে একটি অ্যাশ কালারের প্রাইভেটকার এসে থামে এবং ওই গাড়ি থেকে একজন ভদ্রলোক (আইনজীবী চন্দন সরকার) নেমে চিৎকার করতে থাকে। ওই সময় রানা ওই ভদ্রলোক ও তার ড্রাইভারকে তার মাইক্রোবাসে তুলে নেন। আরিফ ওই ৫ জনকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে কাঁচপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এবং রানাকে বলে তার গাড়িটিকে ফলো করার জন্য। আনুমানিক ১টা ৫০ মিনিটের দিকে ৭ জনকে নিয়ে আরিফ রূপগঞ্জের তারাবো এলাকায় পৌঁছায়। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই রানার গাড়িটি তারাবো পৌঁছায়। তারাবো পৌঁছে আরিফ লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে রিপোর্ট করে যে নজরুলসহ ৭ জনকে আটক করা হয়েছে। তখন তারেক সাঈদ বলেন যে, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না। ৭ জনকেই গুম করে ফেল। তারেক সাঈদের আদেশ পেয়ে আরিফ তার ক্যাম্পের বেলালকে বলেন ৭ সেট ইটের বস্তা তৈরি করার জন্য। তারাবো আসার পথে রানা চিটাগাং রোডে মাইক্রোবাস থেকে নেমে যান এবং তারেক সাঈদের অফিসে চলে যান। আরিফ নায়েক বেলালকে ইটের বস্তা তৈরি করতে বলে মাইক্রোবাস ২টি নিয়ে নরসিংদীর দিকে চলে যায়। আনুমানিক আড়াইটার দিকে আরিফ নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছায়। ওই সময় আরিফ নরসিংদী ক্যাম্প কমান্ডার সুরুজকে ফোন করে এবং তার সঙ্গে ক্যাম্পের বাইরে দেখা করে। ওই সময় আরিফ মেজর সুরুজের নিকট থেকে ২ হাজার টাকা নেয় এবং ক্যাম্পের বাইরে তারা সবাই দুপুরের খাবার খায়। আনুমানিক ৪টার দিকে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার দিকে চলে যায় এবং একটি নির্জন জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকে। আনুমানিক রাত ৮টার দিকে তারেক সাঈদকে আরিফ জানায়, তারা নারায়ণগঞ্জে আসতে চাচ্ছে। তখন তারেক সাঈদ বলেন, রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারি চলছে, আমি ৩ টনি ট্রাক পাঠাচ্ছি। তোমরা ওই ট্রাকে করে আসামিদের নিয়ে এসো। তখন আরিফ তারেক সাঈদকে বলেন, ট্রাক আসতে অনেক দেরি হবে, আমরা মাইক্রোবাস নিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসছি। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে আরিফ গংরা নরসিংদীর বেলা নগর পৌঁছায়। বেলানগর পৌঁছে আরিফ সৈনিক মহিউদ্দিনকে বলেন ৭টি সাকসা (চেতনানাশক ইনজেকশন) এবং একটি সিরিঞ্জ কিনে আনতে। আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার দিকে মাইক্রোবাস ২টি নিয়ে আরিফ গংরা কাঁচপুরে পৌঁছায়। কাঁচপুর পৌঁছে আরিফ একটি পরিত্যক্ত পেট্রোল পাম্পে অপেক্ষা করতে থাকে। ওই সময় আরিফ তারেক সাঈদকে ফোন করে বলে, স্যার রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারি চলছে। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢোকা আমার জন্য ডিফিকাল্ট। রানা স্যার যেন ট্রলারটি কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পাঠিয়ে দেন। তার কিছু সময় পরে রানা তারেক সাঈদের অফিসের ল্যান্ডফোন থেকে আরিফকে জানায়, কাঁচপুর ব্রিজের নিচেই ট্রলার থাকবে। তারপর আরিফ নূর হোসেনকে ফোন করে বলে, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে যেন মানুষের কোনো জটলা না থাকে। আনুমানিক রাত ১১টার দিকে আরিফ মাইক্রোবাস ২টিসহ কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএ এর ঘাটে পৌঁছায়। আনুমানিক রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেলালকে ফোন করে আরিফ বলে ইটের প্যাকেটগুলি কাঁচপুর ব্রিজের নিচে নিয়ে আসতে। সকাল বেলা হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল কোর্টে নজরদারি শেষে আদমজীনগর ক্যাম্পে ফিরে গিয়েছিল। ওই দিন কোর্টে নজরদারি করার সময় নজরুলের লোকজন সিপাহি তৈয়বকে সন্দেহ করেছিল এবং আটক করেছিল। পরে তৈয়ব পরিচয় দিয়ে বের হয়ে যায়। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে একটি সাদা মিতসুবিশি মাইক্রোবাসে করে হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল, সৈনিক আরিফ, সৈনিক তাজুল ইটের প্যাকেটগুলি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ এর ঘাটে আসে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে রানার ট্রলারটি কাঁচপুর ব্রিজের নিচে আসে। ট্রলারটি আসার পর আরিফ  এমদাদকে ইটের প্যাকেটগুলি ট্রলারে লোড করতে বলে। তারপর আরিফ তারেক সাঈদকে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে বলে ৭ জনকে গুম করার বিষয়ে সে প্রস্তুত। ওই সময় তারেক সাঈদ আরিফকে বলেন, ওকে গো এহেড। তারেক সাঈদের আদেশ পেয়ে আরিফ নায়েক হিরা, সিপাহী তৈয়বকে বলে মাইক্রোবাসে থাকা ৭ জনকে সাকসা ইনজেকশন পুশ করতে। রানার মাইক্রোবাসের লোকজনকে বলে এলাকায় পাহারা দিতে। ইনজেকশন পুশ করার পর নায়েক বেলাল, নায়েক হীরা, সিপাহী তৈয়ব, এসআই পুর্নেন্দু বালা, সৈনিক আলামিন, সৈনিক তাজুল, কনস্টেবল শিহাব ও সৈনিক আলীম এই ৮ জনে আটককৃত ৭ জনের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং আরিফকে অবহিত করে। তারপর আরিফ সবাইকে ডেড বডিগুলি ট্রলারে লোড করার জন্য বলেন। তারপর আরিফ তার টিমসহ ট্রলারে উঠে এবং রানার টিম ও সব গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আরিফ লাশ নিয়ে আনুমানিক ১টার দিকে ট্রলার নিয়ে মেঘনা নদীর মোহনার দিকে রওনা দেয়। আনুমানিক রাত আড়াইটার দিকে ট্রলারটি নিয়ে মেঘনা নদীর মোহনায় পৌঁছায়। মেঘনা নদীর মোহনায় পৌঁছে আরিফের টিমের সদস্যরা প্রতিটি ডেডবডির সঙ্গে এক সেট ইটের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। শেষ হয় অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের মিশন। কিন্তু বিধিবাম ৩০শে এপ্রিল একে একে ৬টি লাশ ভেসে ওঠে। পরের দিন আরো একটি। শুরু নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে তোলপাড়। পর্যাক্রমে গ্রেপ্তার হয় র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা ও তাদের ১৩ সহযোগী। এবং নুর হোসেনের ৪ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করার পর ২০১৪ সালের ১২ই নভেম্বর ভারতের কারাগার থেকে দেশে এনে ১৩ই নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ আদালতে তোলা হয় মামলার অন্যতম আসামি নুর হোসেনকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *