যুগান্তকারী বিচার

Slider জাতীয়

49468_f1

 

ঢাকা; যুগান্তকারী বিচার, ঐতিহাসিক রায়। নারায়ণগঞ্জের  সেভেন মার্ডার মামলায় র‌্যাব-এর সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া ৯ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। রায়ে আদালত বলেছেন, এ মামলার আসামিরা সবসময় অপরাধমূলক মানসিকতা ধারণ করতো। তাদের অপরাধ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ৪১ কার্যদিবস শুনানি শেষে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত  হোসেন জনাকীর্ণ আদালতে গতকাল সকাল ১০টায় সংক্ষিপ্ত সময়ে এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। আসামিদের অপরাধের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ অংশ বাদ দিয়ে  কেবল সাজার অংশটিই তিনি পড়ে শোনান। আসামিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত ২৬ আসামির প্রত্যেককে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেন। এবং অপহরণ ও আলামত বিনষ্ট করার অপরাধে বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন। রায় ঘোষণার সময় মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ২৩ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় শোনার পর নুর হোসেন এবং র?্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানাকে নির্বিকার থাকতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে  কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। তবে মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনে লোহার খাঁচার ভেতরে থাকা কয়েকজন আসামি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। এ সময় তাদের সান্ত্বনা দেন নুর হোসেনসহ অন্য আসামিরা। রায় ঘোষণার পর কড়া পুলিশ পাহারায় আসামিদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি যারা: রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন- র?্যাব-১১ এর সাবেক কর্মকর্তা লে. তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন, এমএম রানা, এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এস আই পুর্ণেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম,  সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর,  সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম ও সার্জেন্ট এনামুল কবীর। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাকিরা হলেন সাবেক কাউন্সিলর নুর হোসেন, তার গাড়িচালক মিজানুর রহমান দীপু, ক্যাশিয়ার রহম আলী, সহযোগী আলী মোহাম্মদ, আবুল বাশার,  মোর্তুজা জামান (চার্চিল), সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, ম্যানেজার শাহজাহান ও ম্যানেজার জামাল উদ্দিন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা ও শাহজাহান পলাতক রয়েছেন।
বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত যারা: রায়ে বিভিন্ন  মেয়াদে কারাদণ্ড পেয়েছেন র?্যাব-১১ এর সাবেক সদস্য এএসআই আবুল কালাম আজাদ (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), এএসআই বজলুর রহমান (সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর), এএসআই কামাল হোসেন (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), কর্পোরাল রুহুল আমিন (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), হাবিলদার নাসির উদ্দিন (সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর), কনস্টেবল বাবুল হাসান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর, সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর) ও সৈনিক নুরুজ্জামান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর)।
পলাতক ১২ আসামি: দণ্ড পাওয়া পলাতক ১২ আসামির মধ্যে র‌্যাবের ৮ সদস্য ও নুর হোসেনের ৪ সহযোগী রয়েছেন। তারা হলেন- নুর হোসেনের সহযোগী ভারতে গ্রেপ্তার সেলিম ওরফে বোল্ডার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামাল উদ্দিন, র‌্যাবের সদস্য কর্পোরাল লতিফুর রহমান,  সৈনিক আবদুল আলী, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী,  সৈনিক আলামিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, এএসআই কামাল হোসেন ও কনস্টেবল হাবিবুর রহমান।
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য: রায় ঘোষণার প্রেস ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালতে একটি নির্ভুল রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আসামিরা আপিল করলেও আমি আশা করি উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায় বিচার পাবো। অনেক সুষ্ঠুভাবে বিচার কার্য সম্পাদিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিচার ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা পর্যন্ত একটি ন্যায় বিচার হোক প্রত্যাশা করেছেন। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ সকল আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বিধায় আদালত সব আসামিকেই সাজা দিয়েছে। এ রায়ে আমরা খুশি। নারায়ণগঞ্জবাসী তো বটেই পুরো দেশবাসী ও বিশ্ববাসী তাকিয়ে ছিল এ রায়ের প্রতি। আমি মনে করি মানুষ ও বিচারপ্রার্থীদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। বহুল আলোচিত এ রায়ে প্রমাণ হয়েছে আইন সকলের চোখে সমান। কে কোন্‌ বাহিনীর, কোন্‌ সংস্থার, কে জনপ্রতিনিধি, কে রাজনীতিক সেগুলো আদালতের কাছে বিবেচ্য না। দেশের সংবিধানের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। সে যত বড় প্রভাবশালী বা চেয়ারের মালিক হোক। দায়িত্বপ্রাপ্ত এলিট ফোর্স হিসেবে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে এবং দায়িত্ব থেকে সরকারি পোশাক পরে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড তারা করেছে। আদালত যে কোনো অপরাধীর বিচার করতে পারে, আদালত যে কোনো ব্যক্তিকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারে- এ রায়ের মাধ্যমে এটি প্রমাণ হলো। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কোনো অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না। তা আজকে দৃষ্টান্ত। এলিট ফোর্সের বাহিনী হয়েও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়েও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ নিয়ে এখান থেকে যেতে হয়েছে।
পিপি আরো বলেন, নুর হোসেন পরিকল্পনায় জড়িত। অপহরণ করার জন্য র‌্যাবকে সহযোগিতা করেছেন যা সাক্ষ্যপ্রমাণে এসেছে। নুর হোসেনের সঙ্গে র‌্যাবের একটা সম্পর্ক ছিল। সেই গভীর নিবিড় সম্পর্কের কারণে র‌্যাবের সঙ্গে তার একটা অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। যার কারণে নুর হোসেনের সঙ্গে এ কাজটি করেছে। অপহরণ শেষে হত্যার পর লাশগুলো গুম করার জন্য লোকবল ও তার গাড়ি দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। ২১ জন আসামি ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তার মধ্যে ৪ জন আসামি নুর হোসেনের সহযোগী বডিগার্ড থেকে শুরু করে তার ক্যাশিয়ার। পূর্বশত্রুতার জের ধরে নুর হোসেন কিভাবে র‌্যাবকে ব্যবহার করেছে এবং র‌্যাব কিভাবে জড়িত হয়েছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে তারা তা বলেছেন।
ওয়াজেদ আলী খোকন আরো বলেন, রায় ঘোষণার পর অভিযুক্ত নুর হোসেন ও তারেক সাঈদের ভাবলেশহীন আচরণ প্রমাণ করে তারাই খুনি।  পেশাদার খুনিরাই খুন করার পর হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করতে পারে।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিচার চলাকালে আমি কোনো ধরনের চাপ অনুভব করিনি। মামলাটি পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যদি কোনো চাপ বা তদবির থাকতো তাহলে এ মামলাটি ৮ মাসের মধ্যে ১০৬ জন্য সাক্ষীর সাক্ষ্য করে যুক্তিতর্ক করে রায়ের পর্যায়ে আনা যেতো না। গণমাধ্যমকর্মীদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রায় ঘোষণার সময় পরিস্থিতি বিবেচনায় বিচারক পর্যবেক্ষণ দিতে পারেননি বলে জানিয়েছেন আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন। তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে।
পিপি আরো বলেন, আদালতের রায় ঘোষণার পর সেটার প্রয়োজনীয় নথি প্রস্তুত করে দুপুর পৌনে ২টায় আসামিদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আসামিদের মধ্যে নুর হোসেন, র‌্যাবের তিনজন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, এমএম রানা ও আরিফ সহ ৫ জনকে পাঠানো হয়েছে ঢাকার কাশিমপুর কারাগারে ও বাকি ১৮ জনকে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে রাখা হবে।
রায় ঘোষণার সময় নিহত স্বজনদের যারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন: রায় ঘোষণার আগেই সকাল সাড়ে ৯টায় আদালতের ভেতর অবস্থান নেন নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও মামলার বাদিনী সেলিনা ইসলাম বিউটি, ভাই আব্দুস সালাম, নিহত তাজুল ইসলামের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম রাজু, বাবা আবুল খায়ের, মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন, গাড়িচালক নিহত জাহাঙ্গীরের ভাই শাজাহান সাজু, গাড়িচালক ইব্রাহিমের স্ত্রী হনুফা বেগম ও বাবা আব্দুল ওহাব। রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারা প্রত্যেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান।
এদিকে রায় ঘোষণার সময় আদালতে তারেক সাঈদের বাবা মুজিবুর রহমান ও এমএম রানার শাশুড়ি সুলতানা রহমান শিল্পী  উপস্থিত ছিলেন।
আদালতের ভেতরের চিত্র: নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে ১৮ আসামিকে আদালতের ভেতরে স্থাপিত লোহার খাঁচায় এনে রাখা হয়। এরপর গাজীপুর কাশিমপুর কারাগার থেকে সকাল ৯টা ৭ মিনিটে আনা হয় র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা, নুর হোসেন ও র‌্যাব সদস্য বেলালকে। এরমধ্যে ১৮ আসামির প্রত্যেকের হাতে হাতকড়া ও পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লাগানো ছিল রায় ঘোষণা পর্যন্ত। অন্যদিকে র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে আদালতে ঢুকানোর সময় ডাণ্ডাবেড়ি খুলে দেয়া হয়। একমাত্র নুর হোসেনকে হাতকড়া, ডাণ্ডাবেড়ি ছাড়াও মাথায় হেলমেট পরিয়ে আদালতে আনা হয়। তবে খাঁচার ভেতরে ঢুকানোর আগে হেলমেট খুলে নেয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় নুর হোসেনসহ ২০ আসামি আদালতে স্থাপিত  লোহার খাঁচার (আসামির কাঠগড়া) ভেতরে ছিলেন। আর র?্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা ছিলেন খাঁচার বাইরে। ২৩ আসামি ছাড়াও বাদী ও আসামি পক্ষের বিপুল সংখ্যক আইনজীবী, মিডিয়াকর্মী, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার লোকের উপস্থিতি ছিল আদালতের ভেতর। বিচারক যখন রায় পড়ছিলেন তখন আসামিরা চোখের পলক ফেলছিলেন না, এক দৃষ্টিতে এজলাসের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
আদালতপাড়ার চিত্র: রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে পুরো আদালতপাড়ায় এবং আদালতপাড়ার বাইরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা  জোরদার করা হয়। বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রস্তুত রাখা হয় জলকামান, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশভ্যান ও প্রিজনভ্যান। প্রতিদিনকার মতো আদালতের সামনে কোনো দোকানপাট বসতে দেয়া হয়নি। প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কোনো দর্শনার্থীকে আদালতের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের। আর্চওয়ে স্ক্যান গেট দিয়ে এবং মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেক করা হয়। তবে ক্যামেরাপারসনরা রায় ঘোষণার সময় জজ আদালতে প্রবেশ করতে পারেননি। আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়াও আদালতের আশপাশের এলাকায়ও পুলিশ মোতায়েন ছিল। নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে ১৮ জন ও কাশিমপুর কারাগার থেকে বাকি ৫ জনকে কড়া নিরাপত্তায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির করা হয়।
এক আসামির হুঙ্কার: এদিকে রায় ঘোষণার পর আসামিদের আদালত থেকে বের করে নিয়ে যায় পুলিশ। এ সময় ফটো সাংবাদিকরা ছবি তোলার সময় ক্ষিপ্ত হয়ে আদালত চত্বরে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া এক আসামি জুতা ছোড়ার চেষ্টা করে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেন। তার নাম মিজানুর রহমান দীপু। সে নুর হোসেনের গাড়িচালক।
রায়কে স্বাগত জানিয়ে আইনজীবীদের মিছিল: রায়কে স্বাগত জানিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে আনন্দ মিছিল করেছেন আইনজীবীরা। গতকাল দুপুরে রায় ঘোষণার পর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দীপুর নেতৃত্বে মিছিলটি বের হয়। মিছিলে সাধারণ আইনজীবীরা অংশ নেয়।
মিছিল শেষে সাংবাদিকদের দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দীপু বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো আপোষ করেন না। ৭ খুনের ঘটনার পর অনেকেই সেদিন বলেছিল যে, এ ঘটনার সঙ্গে মন্ত্রী  মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাতা তারেক সাঈদ জড়িত থাকায় সরকার বিচার করবে না। কিন্তু সরকার দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। যার প্রমাণ এই রায়। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক ইচ্ছাতেই ৭ খুনের মতো এতবড় একটি মামলার বিচারকাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হয়েছে।
মিছিলে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিব আল মুজাহিদ পলু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস জুয়েল, মহসিন মিয়া, সুইটি ইয়াছমিন প্রমুখ অংশ নেন।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭শে এপ্রিল অপহরণ পরবর্তী হত্যাকাণ্ডে নিহত ৭ জনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম ছিলেন। ওই বছরের ৩০শে এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী বন্দরের শান্তির চর এলাকা থেকে একেএকে ৭ জনের হাত-পা বাঁধা লাশ ভেসে উঠলে সেখানে নিখোঁজ চন্দন সরকারের লাশও পাওয়া যায়। ঘটনাটি তখন নারায়ণগঞ্জসহ পুরো দেশের আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। যে কারণে ৭ খুন পরবর্তী সময়ে বিচারের দাবিতে নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা সোচ্চার হয়ে উঠে। তাদের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করতে ওই সময় নারায়ণগঞ্জ আসেন, বরেণ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার কামাল হোসেন ও অ্যাডভোকেট আবদুস বাসেত মজুমদার।
২০১৪ সালের ২৭শে এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমানী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীমকে অপহরণ করে র‌্যাব-১১ এর একটি টিম। পরে ৩০শে এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের ও ১লা মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার একদিন পর প্যানেল মেয়র নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে নুর  হোসেনসহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় একই থানায় আরেকটি মামলা হয়। এই মামলার বাদী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। পরে দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ। দীর্ঘ ১১ মাস দুটি মামলার তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ই এপ্রিল নুর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ। এরমধ্যে র‌্যাবের ২৫ জন এবং নুর হোসেন ও তার ৯ সহযোগী। দুটি মামলাতে সাক্ষী করা হয়েছে ১২৭ জন করে। আলামত জমা দেয়া হয়েছে ১৬২ প্রকারের। মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ২৩ জনকে। আর পলাতক থাকে ১২ জন। গত বছরের ৮ই ফেব্রুয়ারি এই মামলায় আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এবং যুক্তিতর্ক শেষ হয় ৩০শে নভেম্বর। ওইদিন যুক্তিতর্ক শেষে আদালত রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন। মামলায় মোট ১০৬ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। র‌্যাব-১১ এর সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এমএম রানা এবং নুর হোসেনসহ ২৩ আসামির উপস্থিতিতে বিচারকার্য সম্পন্ন হয়। পলাতক ১২ আসামির পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ ৫ জন আইনজীবী নিয়োগ দেন। তারা পলাতক আসামিদের পক্ষে বিচারকার্য পরিচালনা করেন। মোটকথা ৩৫ আসামির পক্ষেই চলে মামলার কার্যক্রম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *