ভোটের রাজনীতির সমীকরণ কী পাল্টে যাচ্ছে?

Slider সারাদেশ

46613_f1

 

ঢাকা; আইভী ম্যাজিক। উন্নয়নের প্রতি সমর্থন। নৌকার জোয়ার। সাখাওয়াতের ম্লান ইমেজ। বিএনপির স্থানীয় হেভিওয়েট নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের পর কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। তবে রাজনীতির আঙিনায় এ নির্বাচনের ময়নাতদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
পর্যবেক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি উচ্চারিত হচ্ছে ভোটের রাজনীতির সমীকরণ নিয়ে। নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতিতে সেলিনা হায়াৎ আইভী নিজেকে আইকনের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। স্থানীয় ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে অনেকে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেন তাকে। যে কারণে তার বিজয় কোনো বিস্ময় তৈরি করেনি। ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি ধানের শীষের প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন। ভোটের এই ব্যবধান অবশ্য অনেকের কাছে বিস্ময়কর। বিশেষ করে বিএনপি শিবিরকে তা হতবাক করেছে।
ইতিহাসের প্রায় পুরোটা সময় বাংলাদেশের রাজনীতি মোটাদাগে দু’টি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এরশাদের পতনের পর এই দুই ধারা ভোটের রাজনীতিতে আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। এর একটি ধারার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। অন্য ধারার নেতৃত্বে বিএনপি। এ দু’টি দলের আলাদাভাবে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ ভোট রয়েছে বলে এতদিন ধারণা করা হতো। এর বাইরে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট ছিল। জামায়াতের ভোট ৫ ভাগ বা তার কিছু বেশি বলে মনে করা হতো। জাতীয় পার্টির ভোট ছিল এর থেকে কিছুটা বেশি। বাকি সুইং ভোটই
ফল নির্ধারণ করে দিতো। অংশগ্রহণমূলক প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রায় কাছাকাছি ভোট পেয়েছে। যদিও কখনও কখনও তাদের আসন সংখ্যার ব্যবধান ছিল খুব বেশি। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল না। তাই দু’টি দলের জনপ্রিয়তা পরীক্ষারও কোনো উপায় ছিল না। সাম্প্রতিক বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নৌকা-ধানের শীষই ছিল প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে এসব নির্বাচনে মোটা দাগে দু’টি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে। ১. ওইসব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ছিল না। পেশিশক্তির দাপট যাদের ছিল তারাই বিজয়ী হয়েছেন। ২. সরকার সমর্থক প্রার্থীরা নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছেন।
তবে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রম। এ নির্বাচন সব পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতেই ছিল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। নির্বাচনে পেশিশক্তির কোনো দাপট দেখা যায়নি। রক্তারক্তি হয়নি। কেন্দ্র দখলের ঘটনাও ঘটেনি। কিছু ‘আকবরি’ গবেষক এতোদিন বলে আসছিলেন, আওয়ামী লীগকে কি নির্বাচনে পরাজিত হয়ে প্রমাণ করতে হবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সেইসব গবেষকদের জন্যও এ নির্বাচন শিক্ষা হয়ে এসেছে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। এবং কেউই এ ফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের পর যথারীতি ২০১৯ সালের সম্ভাব্য নির্বাচনও আলোচনায় এসেছে। সে নির্বাচন কেমন হবে, কোন্‌ সরকারের অধীনে হবে সে আলোচনা আলাদা। কিন্তু সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন খানের ভোটের যে ব্যবধান তা কি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেউ কেউ সম্প্রতি প্রকাশিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের একটি জরিপও সামনে এনেছেন। ওই জরিপে বলা হয়েছে, এখন যদি নির্বাচন হয় তাহলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পাবে ৩৮ শতাংশ ভোট। বিএনপি পাবে ৫ শতাংশ ভোট। জাতীয় পার্টি ১ শতাংশ ও জামায়াতে ইসলামী পাবে ২ শতাংশ ভোট। এরআগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পরিচালিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে আওয়ামী লীগ ৩৮ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৫ শতাংশ ভোট পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপটিকে হাস্যকর হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তবে বিএনপির ‘মৌলিক ভোট ব্যাংক’ অক্ষত আছে কি-না সে প্রশ্ন মিলিয়ে যায়নি। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে ধানের শীষের বিপুল ব্যবধানে হার এ প্রশ্ন ওঠার প্রধান কোনো কারণ নয়। কারণ, নারায়ণগঞ্জে নৌকা প্রতীকের ভোটের সঙ্গে সেলিনা হায়াৎ আইভীর ব্যক্তিগত ভোট ব্যাংকের ভোটও যোগ হয়েছে। যা তাকে অপ্রতিরোধ্য জয় এনে দিয়েছে। কিন্তু অনেকদিন ধরেই পর্যবেক্ষকরা এ প্রশ্ন তুলছিলেন, বিএনপি কি তার জমিন হারাচ্ছে। একের পর এক রাজনৈতিক ভুল চাল আর প্রতিপক্ষের নির্ভুল খেলা বিএনপিকে আন্দোলনের লড়াইয়ে জায়গা দেয়নি। বিএনপির ওপর দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কর্তৃত্ব আগের মতো রয়েছে কি-না রাজনীতির অন্দরমহলে সে প্রশ্নও মাঝে মাঝে উচ্চারিত হয়। কিছু ব্যক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিএনপি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যক্তি এবং সাংগঠনিক পর্যায়ে দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি ক্রমশ দরকষাকষির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বিএনপি। আর এই দরকষাকষির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা নিজ দলের কর্মী-সমর্থকদেরও মনোবল ভেঙে দেয়। আর ক্রমশ ক্ষমতাশালীদের দিকে ঝুঁকতে থাকে দোদুল্যমান সমর্থকরা। দীর্ঘসময় ধরে চলে আসা মামলা-গ্রেপ্তার-নিপীড়ন উপেক্ষা করতে পারেননি অনেকেই। বিএনপির ভোট ব্যাংক নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে তেমনই প্রশ্ন রয়েছে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের ভোট ব্যাংক নিয়েও। সরকার ও বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টি উত্তরাঞ্চল থেকে এরইমধ্যে অনেকটাই উৎখাত হয়ে গেছে। ভোটের রাজনীতিতে এ দলের এখন আর তেমন কোনো প্রভাব আছে বলে পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন না। রেজিস্ট্রেশন এবং প্রতীক আর দলের শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে জামায়াত এখন কোথাও নেই। আর এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে গত এক দশকে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যে চাপ ছিল আওয়ামী লীগ সুনিপুণভাবে তা মোকাবিলা করেছে। সরকার এবং দল দু’টোই এখন অপ্রতিরোধ্য। সরকারের কারিশমা কবুল করেছে আন্তর্জাতিক দুনিয়াও। মেগা উন্নয়ন প্রকল্প আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সরকারের পালে বাতাস দিয়েছে ভালোমতোই। কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলেও তা কাটিয়ে উঠতে জোর তৎপরতা চলছে।
এই পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের হারে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন না সমাজ বিজ্ঞানী ও রাজনীতি বিশ্লেষক ড. মীজানুর রহমান শেলী। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। আর নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকেও উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায় না। কারণ এ নির্বাচনে আইভীর ব্যক্তিগত ভোটের সঙ্গে নৌকার ভোট যোগ হওয়ায় তিনি বিপুল বিজয় পেয়েছেন। এরআগের নির্বাচনে নৌকার সমর্থন ছাড়াই আইভী জয়ী হয়েছিলেন। তবে দেশের রাজনীতি এই বিভক্তি মেকি এবং তা দেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না বলে মনে করেন ড. শেলী। তিনি বলেন, গ্রামের একজন কৃষককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনি বাঙালি না মুসলমান। ওই প্রশ্ন তার কাছে হাস্যকর হিসেবে বিবেচিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *