সিলেট কারাগারে  ২০ জন সাজা ছাড়াই  বছরের পর বছর

Slider বাংলার আদালত বাংলার মুখোমুখি

44689_f1

সিলেট;কে খুন হয়েছেন তাই জানেন না, শুধু জানেন সেই খুনের মামলায় তিনি আসামি। হত্যার দায় মাথায় নিয়ে সিলেট কারাগারে প্রায় ১২ বছর ধরে বন্দি আছেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের মৃত আলী হোসেনের ছেলে ফারুক হোসেন। ২০০৫ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি সিলেট কোতোয়ালি থানার মামলায় আটক হয়ে যখন তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর। তারপর জীবনের সবচেয়ে ঝলমলে ১টি যুগ হারিয়ে গেছে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। সব স্বপ্ন হারিয়ে তার জীবন এখন রঙহীন। মা-বাবা-ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কেউই নেই ফারুক হোসেনের। ১৩২ বার তাকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তার হয়ে কেউ লড়বেন- সে আশাও নেই তার। কারাজীবনকে তাই নিয়তি ভেবে নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন ফারুক হোসেন।

কারাজীবনকে নিয়তি মেনে নিয়েছেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বেগমখাল চা বাগান এলাকার মৃত পাণ্ডে জগন্নাথের ছেলে রাজু জগন্নাথও। পৌনে ১৪ বছর ধরে সাজা ছাড়াই বিচারাধীন আসামি হিসেবে তিনি বন্দি আছেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে। সিলেটের ওসমানীনগর থানায় দায়ের হওয়া ২০০৩ সালের একটি হত্যা মামলায় (নং : ০১) অভিযুক্ত রাজু জগন্নাথ নিজের ‘ভাগ্য’ জানতে ইতিমধ্যেই ১১৩ বার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। তবে তার পক্ষ হয়ে লড়ার মতো কেউ না থাকায় প্রতিবারই তাকে ফিরে যেতে হয়েছে কারার অন্ধকারে। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাজুর স্বজনরা যে তাকে দেখতে আসবেন সে সঙ্গতিও তাদের নেই। বন্দি হওয়ার পর এক-দু’বার স্বজনদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তার। কমপক্ষে এমন ২০ জন রয়েছেন সিলেট কারাগারে। কারো পার হয়েছে যুগ, কেউবা পড়ে আছেন বছরের পর বছর ধরে।

ভাইবোন সব আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সোনামুড়া গ্রামের আবদুল গনির ছেলে সেলিম মিয়ারও। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার একটি হত্যা মামলায় (নং : ০৪) ২০০৫ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন। সাড়ে ১১ বছর ধরে বিচারাধীন অবস্থায় বন্দি থাকা সেলিম মিয়াকেও দরিদ্র পরিবারের পক্ষে দেখতে আসা সম্ভব হয় না। বন্দি থাকাকালীন সময়ের মধ্যে ১২৩ বার আদালতে হাজিরা দিলেও সেলিম মিয়ার পক্ষে জামিনের জন্য কাউকে দাঁড় করাতে পারেনি দরিদ্র পরিবারটি।
বিচার শেষ হচ্ছে না, বছরের পর বছর ধরে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বিভিন্ন মামলায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বন্দি আছেন আরো তিনজন। এদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের আবদুল হকের ছেলে সাব্বির আহমদ দুলাল পৌনে ১১ বছর ধরে হাজতি হিসেবে বন্দি আছেন। চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর গ্রামের ইয়াছিন আলীর ছেলে ময়জুল ইসলাম হৃদয়ও পৌনে ১১ বছর ধরে বন্দি আছেন। একই কারাগারে সাড়ে ১০ বছর ধরে বিচারাধীন অবস্থায় বন্দি রয়েছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাদেপাশা গ্রামের ইসলাম উদ্দিনের ছেলে সাইফুল আলম বেলাল।
৫ বছরের বেশি সময় ধরে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছেন ১৪ জন। এদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার চরলাপাং গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে মো. দানা মিয়া ২০০৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন। হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের মৃত শচীন্দ্র সাধুর ছেলে স্বপন ২০০৮ সালের ২৪শে মার্চ থেকে কারাবন্দি রয়েছেন। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কানপুর গ্রামের হরেন্দ্র রায় দাসের ছেলে রবীন্দ্র রায় ২০০৮ সালের ১০ই এপ্রিল থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। ২০০৮ সালের ২৪শে মার্চ থেকে কারার অন্ধকারে আছেন নেত্রকোনা কালিয়াজুরী উপজেলার আদমপুর গ্রামের মৃত রামকৃষ্ণ সিংহের ছেলে নিপেন্দ্র সিংহ। কুড়িগ্রামের চর আলাজি (পলাশবাড়ি) গ্রামের মো. ছাবিদ আলীর ছেলে বুলবুল ২০০৮ সালের ১৯শে জুন থেকে কারাবন্দি রয়েছেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বার্নি শাহপুর গুচ্ছগ্রামের মো. আবদুল গফুরের ছেলে শফিকুল বাশার সম্রাট জেলে আছেন ২০১০ সালের ২৪শে মার্চ থেকে। সিলেট নগরীর কাজিটুলার মৃত আবদুর রফিকের ছেলে মেহরাজ উদ্দিন শিলু ২০১০ সালের ২৮শে জানুয়ারি থেকে হাজতি হিসেবে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার কমরপুর গ্রামের মৃত এরশাদ উল্লাহর ছেলে সার্জন মিয়া গেদাই ২০১০ সালের ৩রা অক্টোবর থেকে বন্দি আছেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে। সিলেট নগরীর আখালিয়া বড়বাড়ির আবু সাঈদের ছেলে এনামুল হক রাজিব  ২০১১ সালের ২৫শে আগস্ট থেকে বন্দি রয়েছেন। সিলেট শহরতলির জালালাবাদের তাজ উল্লাহর ছেলে তেরা মিয়া ২০১১ সালের ১৭ই অক্টোবর থেকে বন্দি রয়েছেন কারাগারে। হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা গ্রামের হাছন আলীর ছেলে মো. আল আমিন ২০১০ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছেন। ২০১১ সালের ১০ই আগস্ট থেকে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার খাসা পণ্ডিতপাড়া গ্রামের মুরাকিব আলীর ছেলে এনাম উদ্দিন বন্দি আছেন। সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার পশ্চিম সিরাজনগর গ্রামের আঙ্গুর আলীর ছেলে আকবর আলী ২০১১ সালের ২৭শে অক্টোবর থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার বাজারকান্দি নয়াবাড়ি গ্রামের নিবাস চন্দ্র সরকারের ছেলে নয়ন চন্দ্র সরকার ২০১০ সালের ৪ঠা জুন থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি হিসেবে রয়েছেন।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট ই ইউ শহীদুল ইসলাম শাহীন  বলেন, বিনা বিচারে কোনো মানুষকে আটক রাখা বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। তিনি বলেন, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে ১০ বছরের ঊর্ধ্বকাল যাবৎ ৬ জন ও ৫ বছরের ঊর্ধ্বকাল যাবৎ ১৪ জন বন্দি আছেন যাদেরকে ‘বিচারাধীন হাজতি’ বলেই বলা হচ্ছে। সিনিয়র এ আইনজীবী প্রশ্ন রাখেন- ১২/১৩ বছর ধরে যাকে বিচারের নামে আটকে রেখে ১৩০ থেকে ১৩২ বার আদালতে আনা-নেয়া করা হয়েছে- সেই ব্যক্তিকে কোন্‌ যুক্তিতে বলা হবে তিনি বিচারাধীন। অ্যাডভোকেট শাহীন বলেন, আমার মতে এ ধরনের আটক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। কারণ দীর্ঘদিন আটক ব্যক্তিদের জামিনের আবেদন করার জন্য জেলা জজকে প্রধান করে প্রতিটি জেলায় লিগ্যাল এইড কমিটি রয়েছে।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংগঠন ব্লাস্টের সিলেটের কো-অর্ডিনেটর ইরফানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এভাবে বিচারের অপেক্ষায় দীর্ঘদিন বন্দি থাকা অবশ্যই দুঃখজনক। তিনি বলেন, এ বন্দিদের বিষয়টি তাদের নজরে আসেনি। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সভায়ই তিনি বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে জানান।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ছগির মিয়া  বলেন, বন্দিদের হেফাজতে রাখাই আমার দায়িত্ব। আমার চেষ্টা থাকে বন্দিরা যেনো ভালো থাকে, তাদের প্রতি যেনো কোনো অন্যায় না হয়। নিজের জায়গায় থেকে যতটুকু সম্ভব অসহায় বন্দিদের সাহায্যের চেষ্টা করি। বিচারাধীন অবস্থায় ৫ বছরের বেশি কেউ কারাগারে বন্দি থাকলে আমি তখনই বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবগত করার চেষ্টা করি। যারা কারা পরিদর্শনে আসেন তাদের নজরেও আনার চেষ্টা করি সেই সব বন্দিকে। জেল সুপার নয় একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই চাই বিনা বিচারে বা বিচারের অপেক্ষায় থেকে থেকে কারো জীবনের একটি মুহূর্তও যেনো নষ্ট না হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *