আহত দুঈ সাঁওতালকে ঢাকায় প্রেরণ; সাঁওতাল পল্লীতে কাদের সিদ্দিকী

Slider বাংলার মুখোমুখি

khairul-islam-03-1

রংপুর ডেস্কঃ গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের সাঁওতালদের উপর হামলা, লুটপাট ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার দু’সপ্তাহ পর পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হয়ে আসছিল তখন ইক্ষু খামারের আখ ক্ষেতে শনিবারের অগ্নিকান্ডের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই ঘটনায় সাঁওতাল পল্লীর সাঁওতালদের মধ্যে আবারও নতুন করে মামলা আতংক দেখা দিয়েছে। কেননা চিনিকলের আখ ক্ষেতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একটি পক্ষ সাঁওতালদের দোষারোপ করতে তাদের উচ্ছেদকৃত বসতি এলাকার আখ ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আবার সাঁওতালদের ধারণা তাদের নতুন করে ফাঁসাতেই মিল কর্তৃপক্ষের লোকজন পরিকল্পিতভাবে আখ ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

চিনিকল কর্তৃপক্ষ সুত্রে জানা গেছে, অগ্নিকান্ডে ৩৩ বিঘা জমির আখ পুড়ে গেছে। তাতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার আখ পুড়ে যায়। চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল আউয়াল জানান, মিল চালু থাকলে আগুনে পোড়া আখ ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যবহার করেও চিনি উৎপাদন করা যেতো। কিন্তু মিল বন্ধ থাকায় সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। এব্যাপারে মিলের পক্ষ থেকে গোবিন্দগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হবে বলে তিনি জানান।
আহত দু’জন সাঁওতালকে ঢাকায় প্রেরণ: ৬ নভেম্বর সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার এলাকায় সাঁওতাল, মিল শ্রমিক ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় মাদারপুর গ্রামের আহত চরণ সরেন ও বিমল কিসকু আবারও গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় তাদের শনিবার রাতে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাসকে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানায়।

উল্লেখ্য, চরণ সরেন ও বিমল কিসকু পুলিশের তত্ত্বাবধানে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে কিছুটা সুস্থ হলে পুলিশ তাদের গাইবান্ধায় নিয়ে আসে এবং আদালতের নির্দেশে জেলহাজতে প্রেরণ করে। এরপর তারা ১৮ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর তারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে।

গৃহহীন সাঁওতালরা এখনও খোলা আকাশের নিচেঃ গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার এলাকা থেকে উচ্ছেদ হওয়া মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের উদ্বাস্তু সাঁওতালরা খোলা আকাশের নিচে মাদারপুর মিশন গীর্জা সংলগ্ন খোলা মাঠ, গাছ-গাছালির আড়ালে এবং পরিত্যক্ত ঘরের বারান্দায় বসবাস করছে। অনেকে এই শীতে কুয়াশায় ভিজে অতিকষ্টে কলা গাছের পাতা দিয়ে ঘর বানিয়েও সেখানে থাকছেন। এছাড়া সেখানেই চুলো বানিয়ে রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করছেন। কেউ কেউ আবার এই ঘর বানানোর উপকরণ যোগাড় করতে না পেরে খোলা আকাশের নিচেই বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। ওই এলাকায় বসবাসকারি সাঁওতালরা খাবার পানি, ল্যাট্রিন ও ইউরেনাল সমস্যায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে যে রিলিফ দেয়া হচ্ছে তা দিয়েই তারা জীবন ধারণ করছে। কর্মহীন এসব সাঁওতাল পরিবারগুলোর হাতে নগদ টাকা এবং বসতবাড়ি না থাকাটাই এখন মূল সমস্যা বলে সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে সাঁওতালদের নিকট থেকে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও মিল কর্তৃপক্ষের যৌথ সংবাদ সম্মেলনঃ ৬ নভেম্বর গোবেন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাথে মিল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে সংঘটিত ঘটনাবলীর বিষয়ে রোববার (২০ নভেম্বর) জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে যৌথ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ, পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম ও রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল আউয়াল বক্তব্য রাখেন। লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, আইন শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরণের বক্তব্য প্রকাশিত হচ্ছে। এতে আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রতি সর্বসাধারণের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। সেজন্য প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহবান জানানো হয়। যাতে আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রতি সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির বিষয়টির অবসান হয়।

৬ নভেম্বর ঘটনা সম্পর্কে জানানো হয়, সাহেবগঞ্জ খামার এলাকায় কোন উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়নি। প্রথমে আখের বীজ সংগ্রহের জন্য ইক্ষু কর্তন করতে গেলে মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের উপর আদিবাসীরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাদের আক্রমণ চালায় এবং তাদের কাছ থেকে ইক্ষু ছিনিয়ে নেয়। ওই সময় সংবাদ পেয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানা অফিসার ইনচার্জ ও ফোর্সসহ উপস্থিত হলে শত শত আদিবাসী তীর-ধনুক দিয়ে পুলিশ সদস্যের উপর হামলা চালায়। এতে ৮ জন পুলিশ সদস্য তীর বিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। তখন সরকারি সম্পত্তি ও নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন শৃংখলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের নির্দেশে উচ্ছশৃংখল আদিবাসীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য প্রথমে গ্যাসগান ও শর্টগানের গুলি ছোড়ে।

সংশ্লিষ্ট এলাকায় এখন সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্মে পর্যাপ্ত পুলিশ অফিসার ও ফোর্স দিবা-রাত্রিকালিন নিরাপত্তা ডিউটিতে মোতায়েন রয়েছে। বর্তমানে উক্ত এলাকার আদিবাসীরা তাদের নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে দৈনন্দিন কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সন্তানরা নির্বিঘ্নে স্কুলে যাতায়াত করছে ও সকল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে।

তবে কিছু কিছু সাঁওতাল বিভিন্ন জেলার যেমন দিনাজপুর, রংপুর, জয়পুরহাট ও চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসে ফার্ম এলাকায় জমি পাবে বলে দাবি করছে। তারা মাদারপুর, সাহেবগঞ্জ এবং জয়পুর গ্রামে অবস্থান করছে এবং দিনের বেলায় মাদারপুর গীর্জার সামনে অবস্থান করে। তদুপরি এদের মধ্যে অনেকের আবার পার্শ্ববর্তী গ্রামে বাড়িঘর রয়েছে। তারাও দিনের বেলায় এখানে এসে রান্না করে খাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সুতরাং আইন অনুযায়ি যাদের কাছে জমি নেয়া হয়েছে, তাদের বা অন্য কোন ব্যক্তিকে ওই জমি আর ফেরত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে একমাত্র উপযুক্ত আদালত আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি সিদ্ধান্ত দেয়, তবেই এর ব্যত্যয় ঘটতে পারে।

khairul-islam-01

উল্লেখ করা হয়, মাদারপুর এবং জয়পুর গ্রামে ৩১ জন গৃহহীন সাঁওতাল চিহ্নিত করা হয়েছে। যাদের সরকারি ১৪.২৬ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ৪টি আশ্রয়ন প্রকল্পে গৃহহীন এই সমস্ত সাঁওতালদের পুনর্বাসিত করা হবে।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীঃ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তার দলের ১শ’ জনের একটি প্রতিনিধি দল রোববার সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার এলাকার সাঁওতাল পল্লী পরিদর্শন করেন।

এসময় এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি আশা করবো খুব দ্রুত সরকারের বোধদয় হবে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের যেসব জমি দখল করে নেয়া হয়েছে তা অবিলম্বে ফেরত দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। এই জমি উদ্ধারের নামে যাদের হত্যা করা হয়েছে তার বিচার চাই। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে তার সর্বনাশ করার জন্যই তার দলের লোকজনই এ সমস্ত ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। তাই এখনই তাদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক হতে হবে। উচ্চ আদালত ধান কাটার যে রায় দিয়েছে তা সাঁওতালরা যেন সময়মত কাটতে পারে সেব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান।

জেএসডি নেতৃবৃন্দের সাঁওতাল এলাকা পরিদর্শনঃ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সভাপতি আ.স.ম. আব্দুর রব রোববার (২০ নভেম্বর) দুপুরে দুর্দশাগ্রস্ত সাঁওতালদের এলাকা পরিদর্শন করেন। তার সাথে ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এম.এ গোফরান, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন, যুগ্ম সম্পাদক আশিষ সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক আমির উদ্দিন এবং জেলা জেএসডি সম্পাদক লাসেন খান রিন্টু।

আ.স.ম. আব্দুর রব সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে বলেন, জনগণের সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অক্ষম। ভোটের রাজনীতির কাছে সকল বন্ধন সম্প্রীতি সৌহার্দ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, হাইকোটের রায়ের ভিত্তিতেই উদ্ভুত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের তাদের পৈত্রিক জমিতে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে বলেন, ইক্ষু খামারের ওই জমি তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি। এটা সরকার বা চিনিকল কর্তৃপক্ষের বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়। এছাড়া তিনি এখানে সংঘটিত ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তও দাবি করেন।

ত্রাণ বিতরণঃ এদিকে ত্রাণ বিতরণকালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী রোববার সাঁওতাল পল্লী পরিদর্শন করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের মধ্যে কম্বল বিতরণ করেন। তিনি বক্তব্য রাখার সময় সরকারি জমিতে সাঁওতালদের পুনর্বাসনের কথা বললে উপস্থিত সাঁওতালরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তাদের উচ্ছেদকৃত জমিতেই পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে শ্লোগান দিয়ে তাৎক্ষনিক ওই এলাকায় মিছিল করতে থাকে। এছাড়া সাঁওতাল পল্লীতে শনিবার ক্ষেতমজুর সমিতি, কৃষক সমিতি, যুব ইউনিয়ন ও ভূমি রক্ষা সংগ্রাম সংহতি পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অসহায় সাঁওতালদের সহায়তা হিসেবে শিশু খাদ্য, চাল, ডালসহ নগদ অর্থ এবং নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরন করে।

উল্লেখ্য যে, গত ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের আখের বীজ কাটাকে কেন্দ্র করে খামারের জমি দখলকারী আদিবাসী সাঁওতালের সাথে শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাওতালদের নিক্ষিপ্ত তীর-ধনুকের আঘাতে ১০ পুলিশ তীরবিদ্ধ সহ ৩০ জন আহত হয়। এঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানায় ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত সাড়ে ৩শ’ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *