২০ কেজি চিনির সমান এক মুঠো সাইক্লামেটু

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

 

18269_f3

 

 

 

 

খাদ্যদ্রব্য মিষ্টির জন্য ২০ কেজি চিনির পরিবর্তে এক মুঠো নাম্বার ওয়ানই যথেষ্ট। এর আগে এই নামটি শোনেনি দেশের মানুষ। কারণ এটি চিনির মতো কোনো খাদ্যদ্রব্য নয়। সোডিয়াম জাতীয় এই পদার্থ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হতে পারে মানুষের। চিনির পরিবর্তে বিষাক্ত এই পদার্থ ব্যবহৃত হচ্ছে ইফতার সামগ্রীতে। দেশের বাজারে সোডিয়াম সাইক্লামেট হিসেবে প্রবেশ করেছে এটি। তবে বিক্রেতারা এটিকে  নাম্বার ওয়ান বলে থাকেন। পানীয়, জুস জাতীয় ইফতার সামগ্রীতে মিশানো হচ্ছে এই বিষ। এছাড়া খেজুর, মুড়ি থেকে শুরু করে কোনো সামগ্রী নিরাপদ না। ফরমালিন থেকে শুরু করে, রাসায়ানিক কেমিক্যাল, বিভিন্ন ধরনের রং, পুরনো তেল এমনকি মবিলও মেশানো হচ্ছে। এসব ভেজাল সামগ্রী খাওয়ার ফলে কিডনি, লিভার এমনকি ব্রেইন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিকাল হলেই যত্রতত্র বসছে ইফতারের হাট। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি হচ্ছে এসব ইফতারি। পুরনো তেলের ব্যবহার প্রকাশ্যে দেখলেও এতে তৈরি সামগ্রী কিনতে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে সেখানে শুরু হয় ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন।
বেইলী রোড, মিরপুর, পুরান ঢাকার চকবাজার, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ীসহ অলিগলিতে তৈরি হচ্ছে বাহারি ইফতার সামগ্রী। সূত্রমতে, ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট (বিএসটিআই), জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশন। কিন্তু রমজান শুরুর পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযান হয়নি। যদিও র‌্যাব’র উদ্যোগে মিরপুর, মিডফোর্ডসহ কিছু এলাকায় ফলের বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, জুস জাতীয় ইফতার সামগ্রীতে ময়দার মতো একটা পদার্থ মেশানো হচ্ছে। এতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট। মিডফোর্ট ও ও চকবাজারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তা বিক্রি হচ্ছে। গত বুধবার মিরপুরের পল্লবীর একটি সোডিয়াম ফ্যাক্টরি থেকে এই পদার্থ জব্দ করেছে র‌্যাব। তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ওই ফ্যাক্টরির ম্যানেজার সজলকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে র‌্যাব-২ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিন জানান, সোডিয়াম সাইক্লামেট মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এটি আমদানি নিষিদ্ধ। মূলত ইন্ড্রাস্ট্রিতে ব্যবহৃত হয় এই পদার্থ। যেখানে ৫০ কেজি চিনি প্রয়োজন সেখানে এটি ১ কেজিতেই যথেষ্ট। এই ভেজাল পদার্থ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি জাতীয় জুস, চকলেট, আইসক্রিম এবং কনডেন্সডমিল্ক তৈরি হচ্ছে। এটি চায়নায় তৈরি। অল্প দামে পাওয়া যায় বলে এটি অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ব্যবহার রোধ করতে এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালত জোরদার করা হবে বলে জানান তিনি।
ইফতার সামগ্রীর অন্যতম হচ্ছে জিলাপি। এই জিলাপিতে মবিল, বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত রং ছাড়াও ব্যবহার করা হচ্ছে হাইড্রোজ। সূত্রমতে, হাউড্রোজ ব্যবহার হচ্ছে অভিজাত ইফতার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্র। গত বৃহস্পতিবার বেইলী রোডের হক রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে হাইড্রোজ জব্দ করা হয়েছে। হাইড্রোজ ব্যবহারের দায়ে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিককে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাব’র ভ্রাম্যমাণ আদালত। র‌্যাব-৩ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম জানান, হাইড্রোজ ব্যবহার করার ফলে তৈরি জিলাপি পাঁচ-সাত দিন পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। এটি পচন থেকে রক্ষা এবং শক্ত করে। কিন্তু রাসায়নিক এই পদার্থ মানুষের শরীরের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে।
এছাড়া বোম্বে জিলাপি বা মোটা জিলাপিতে ব্রেকিং পাউডারের সঙ্গে এক জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। যা জিলাপিকে নরম ফুলিয়ে তোলে। নিষিদ্ধ ওই পদার্থটি মানুষের হার্টের জন্য ক্ষতিকর বলে চিকিৎসকরা জানান। জিলাপিকে দীর্ঘক্ষণ মচমচে রাখতে ভোজ্যতেলের সঙ্গে ব্যবহার হচ্ছে মবিল। জিলাপিতে বিষাক্ত কেমিক্যালের পাশাপাশি ব্যবহার হচ্ছে বাসন্তী রঙ। ফলে সাধারণ জিলাপি থেকে এসব জিলাপি বেশ উজ্জ্বল দেখায় ও মচমচে থাকে। এছাড়াও ইফতারের অন্যতম মুড়িকে ধবধবে সাদা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। আর মুড়ির দানা বড় করতে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক সার। বেগুনি, পেঁয়াজু ও আলুরচপ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন বিষাক্ত রঙ। এসব রঙ ব্যবহার করা হয় টেক্সটাইল মিলগুলোতে।
সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মেয়াদ উত্তীর্ণ বনরুটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে স্যান্ডউইচ। বেইলী রোডের এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান ফুডকোর্ট। ওই প্রতিষ্ঠানকেও ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে আভিজাত্য ইফাতারি। এর অধিকাংশ বিক্রেতা রোস্টে ক্ষতিকর রং ব্যবহার করছেন। একইভাবে ছোলা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান গরুর ছোলাজাতীয় খাবার। বিষয়টি র‌্যাব’র নজরে রয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে বলে জানান র‌্যাব-২ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিন।
এসব ভেজাল খাদ্যে নানা ধরনের রোগের উৎপত্তি থেকে শুরু করে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি চরম। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, বদহজম, খাবারের সঙ্গে ফরমালিন, কার্বাইড মেশানের ফলে লিভার, কিডনি, ব্রেইন, হার্টসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভেজালে-বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এজন্য আইন-প্রয়োগ করতে হবে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *