সংসদ-আদালত মুখোমুখি

Slider জাতীয়
untitled-8_210566
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে আবারও মুখোমুখি অবস্থানে সংসদ ও বিচার বিভাগ। সংসদ সদস্যরা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সার্বভৌম। সংসদের পাস করা আইন আদালত বাতিল করলে সংসদের মর্যাদা থাকে না। অন্যদিকে বিচার বিভাগ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের রক্ষক। বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এই সংশোধনী বাতিলযোগ্য।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রধান তিন অঙ্গ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে পৃথক মর্যাদা দেওয়া রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করলেও আপিল বিভাগের আবেদনের সুযোগ রয়েছে। সেখানেই এই বিতর্কের সমাধান হতে হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, আমরা সংসদে আইন পাস করি। আবার সেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। হাইকোর্টের এই রায় সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নয়। আপিল বিভাগে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তার মতে, সংসদের পাস করা আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেই কেবল বিচার বিভাগ বাতিল করতে পারে। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটি ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তাই একে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। আদালতের এই রায় সংবিধান পরিপন্থী।

গত বৃহস্পতিবার আদালতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ সময় তারা স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর রুলিং দাবি করেন। এ বিষয়ে গতকাল স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, রুলিং দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন। তবে এখনও তিনি সিদ্ধান্ত নেননি। আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রাষ্ট্রের প্রধান তিন স্তম্ভ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে স্পিকারের রুলিং দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর আগে পঞ্চম সংসদের স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী এক রুলিংয়ে বলেছিলেন, ‘আদালতের হাত অনেক লম্বা। তবে এত লম্বা নয় যে, তা সংসদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’ বিশ্লেষকদের মতে, সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ ও আদালতের কর্তৃত্ব নিয়ে বিতর্ক অনেক পুরনো। নিকট অতীতেও এর আগে সংসদের স্পিকার সম্পর্কে আদালতের একটি বেঞ্চের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে আদালত ও সংসদ মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল। ২০১২ সালের ৬ জুন সংসদের বৈঠকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। ওই বেঞ্চের দুই বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা।

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সমকালকে বলেন, ‘বাহাত্তরের মূল সংবিধানের পরিপন্থী হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে সার্বভৌম জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদকে অপমান করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ। এরা একে অপরের পরিপূরক। সংসদ-আদালত কখনও মুখোমুখি ছিল না। হাইকোর্টের রায়ের ব্যাপারে সাংসদরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। কারণ সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তা সংসদ ছাড়া সকলের জন্য কার্যকর। যতক্ষণ পর্যন্ত না এই রায় আপিল বিভাগে স্থগিত বা বাতিল না হয় ততক্ষণ এ রায় মানতে হবে।

ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেন, হাইকোর্টের এই রায় চূড়ান্ত নয়। অ্যাটর্নি জেনারেলও রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের কথা জানিয়েছেন। এই বিষয়টি আপিল বিভাগেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। বিচারাধীন বিষয়ে আর কোনো কথা বলা ঠিক হবে না। সংসদ-আদালত মুখোমুখি প্রসঙ্গে প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘কোন মামলায় সরকার হারে নাই? আদালতের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো যায় না।’

ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘একটি সংক্ষিপ্ত রায় হাইকোর্ট থেকে আমরা পেয়েছি, এটাই চূড়ান্ত নয়। ইতিমধ্যে এ রায় নিয়ে সংসদে যে ধরনের মন্তব্য এবং ঝড়-পাল্টা ঝড় উঠেছে তা যথার্থ প্রতিক্রিয়া হতে পারে না। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এই রায় দিয়েছেন তার বিস্তারিত উল্লেখ করবেন।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনও মনে করেন, ‘হাইকোর্টের রায় চূড়ান্ত নয়। রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ওই রায় স্থগিত হতে পারে। তার আগে রায় নিয়ে সমালোচনা যৌক্তিক নয়।’ সংসদে রায় নিয়ে সাংসদের প্রতিক্রিয়া দেখানো_ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রায়ের ওপরে এমপিরা সংসদে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেই পারেন।’ একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। তার মতে, ‘সংসদে সর্বোচ্চ আদালতকে আক্রমণ করে যেভাবে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে এর ফলে আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে, এটাই চূড়ান্ত সমাধান।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছে। তাই রায় নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক হবে না। এতে রাজনীতিবিদরা আদালতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জনমনে ধারণা তৈরি হতে পারে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘বাহাত্তরের মূল সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো রায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে রোববার আপিল করা হবে। বিষয়টি আপিল বিভাগে সুরাহা হবে।’

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘এর আগে আরও চারবার সংবিধান সংশোধনী আদালত বাতিল করেছেন। তখন এ নিয়ে সংসদে উচ্চবাচ্য হয়নি।’ তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বর্তমান সরকার এবং এই সংসদের পাস করা আইন হওয়ার কারণে বর্তমান সাংসদরা উষ্মা প্রকাশ করবেন, প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, এটাই স্বাভাবিক। কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া মাত্রাতিরিক্তি হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।

ড. শাহ্দীন মালিকের মতে, সংবিধান রক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্ব ও ভূমিকা সঠিক অনুধাবন না করার কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের রায় যদি আপিল বিভাগে বহাল থাকে, তাহলে যতই অপছন্দ হোক না কেন শেষ পর্যন্ত সংসদকে এই রায় মেনে নিতেই হবে।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীকে যদি সংসদের মাধ্যমে অপসারণ করা যায়, তাহলে বিচারপতিদের ক্ষেত্রে বাধা কোথায়_ এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতি অপসারণের যে বিধান ছিল, সেখানে অপসারণের জন্য দুটি আইন করার কথাও বলা হয়েছিল। ওই দুটি আইনে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের প্রক্রিয়া এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিচারকের বিরুদ্ধে সংসদে সেটি কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, তা উল্লেখ থাকার কথা। এটা কিন্তু হয়নি। ওই আইন হলে তখন এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।

আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, সাংসদদের মতামত দেওয়ার অধিকার রয়েছে। সংসদ বা আইন সভা যেমন স্বাধীন, তেমনি বিচার বিভাগও স্বাধীন। তবে নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন কাজে বিচার বিভাগ হস্তক্ষেপ করছে এমন নজিরও তো রয়েছে। তার মতে, সংবিধান সংশোধন নিয়ে আদালতের রায় নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। একে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে মনে করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আপিল বিভাগ রয়েছে। সেখানেই এই বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম বলেন, আদালতের এখতিয়ার কতটুকু সংসদ সদস্য হিসেবে তা আমাদের জানা দরকার। কারণ আমরা সংসদে যে আইন পাস করি তা যদি একটার পর একটা অবৈধ হয়ে যায় তাহলে তো আইনসভার মর্যাদা থাকে না।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাস হয়। রাষ্ট্রপতির সম্মতিসূচক স্বাক্ষরের পরে ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এরপর একই বছরের ৫ নভেম্বর ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করেন আসাদুজ্জামান সিদ্দিকীসহ সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী। ওই রিটে ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, আইন সচিব ও সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। তারা রুলের জবাব দেওয়ার পর গত বছরের ২১ মে এ বিষয়ে মতামত দিতে হাইকোর্ট অ্যামিকাস কিউরি (আদালতে মতামত প্রদানকারী বন্ধু) হিসেবে জ্যেষ্ঠ পাঁচ আইনজীবীকে মনোনীত করেন। তারা হলেন_ ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম (প্রয়াত), ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি। ২০ কার্যদিবস শুনানি নিয়ে চলতি বছরের ১০ মার্চ হাইকোর্টের এই তিন সদস্যের বিশেষ রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। রায় ঘোষণার আগে অবশ্য গত ২৫ এপ্রিল উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অসদাচরণের জন্য প্রস্তাবিত ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক (তদন্ত) আইন ২০১৬’ নামে একটি আইনের খসড়ায়ও সম্মতি দেয় মন্ত্রিসভা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *