মেয়াদ ফুরাচ্ছে নেই অগ্রগতি

Slider জাতীয়
untitled-2_209543
রাজধানীর পানি সংকট নিরসনে দেড় যুগ আগে ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি বৃহৎ পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে প্রকল্পগুলো শেষ করা হবে। তখন মুন্সীগঞ্জের পদ্মা, নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ও মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি এনে শোধন করে ঢাকায় সরবরাহ করা হবে। ফলে নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ হবে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতাও কমবে। দেড় যুগ পরও প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হয়নি। এগুলোর মধ্যে একটি প্রকল্পের কাজ হয়েছে একেবারেই ছিটেফোঁটা। আরেকটি প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ হলেও কাজ হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। দুটি প্রকল্পের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিই নেই। ওয়াসার কর্মকর্তারাই বলছেন, নির্ধারিত সময়ে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই নাকি প্রকল্পগুলোর এ অবস্থা। একটি প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলাও হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজ উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ করতেই অনেক সময় লাগে। জনগণ জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে নানাভাবে বাধা দেয়। অনেকে মামলা করে। এখানেই এক বছরের কাজে দুই-তিন বছর লাগে।’ তবে দুর্নীতি বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

মেঘনার পানি শোধন প্রকল্প: ঢাকার টেকসই পরিবেশ ও নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৫ সালের দিকে মেঘনা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি এনে ঢাকায় সরবরাহ করার জন্য গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সিদ্ধিরগঞ্জের গন্ধর্বপুরে এলাকায় নির্মাণাধীন এ শোধনাগারে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের শম্ভুপুরা মৌজার বিষনন্দী পয়েন্টের মেঘনা নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি আনা হবে। সেখানে পানি শোধন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে তা রাজধানীতে সরবরাহ করা হবে। এ জন্য মোট ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৬৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (পাঁচ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা)। সর্বশেষ এই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে ১১ হাজার কোটিতে পেঁৗছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা। প্রকল্পটি ২০২১ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা। এখনও প্রকল্পে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে তাও কেউ বলতে পারে না।

প্রকল্প পরিচালক মাহমুদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘সরকারি প্রকল্পের অবস্থা এরকমই হয়। যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়, ওই সময়ের মধ্যে শেষ করা যায় না। বর্তমানে প্রকল্পটি মূল্যায়ন কমিটিতে আছে।’ দ্রুত যাতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যায়, সে জন্য তিনি দোয়া কামনা করেন এ প্রতিবেদকের কাছে।

তেঁতুলঝরা-ভাকুর্তা প্রকল্প: রাজধানীর মিরপুরে পানি সরবরাহের জন্য প্রকল্পটি শুরু হয় প্রায় এক যুগ আগে। ৫২১ কোটি টাকার এই প্রকল্প আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা। এটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার পানি পাওয়া যাবে। ৪৬টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ থেকে পানি তুলে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ শেষ করার কথা। এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক নূরুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজ উদ্দিন জানান, কাজ অব্যাহত রয়েছে।

পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্পে কেবলই অনিয়ম: ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি এনে শোধন করে সরবরাহ করার এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এ জন্য মাওয়ার জশলদিয়া পয়েন্টে ৮২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। অভিযোগ উঠেছে, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স চায়না সিএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে বিনা দরকষাকষিতে কাজ দেওয়ায় ওয়াসার ইতিমধ্যে ৩৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনায় দুদকে মামলাও চলছে। এ প্রকল্পের পরিচালক রশিদ সিদ্দিকীকে সরিয়ে সেখানে প্রথমে নিয়োগ দেওয়া হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উপদেষ্টা বজলুর রহমানকে। তাকে নিযুক্ত করা হয় দুই বছরের জন্য। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বজলুর রহমানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের আদেশ জারি করা হয়। এর পর ১৯ এপ্রিল নতুন করে প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত করা হয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামকে। এভাবে বারবার প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়ায় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এ প্রকল্পের ৩৩ কিলোমিটার পাইপলাইনের জন্য চীন থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাইপ আমদানি করা হয়। এসব পাইপের ব্যাস ২১ মিলিমিটার হওয়ার কথা। যদিও আমদানি করা হয় ১৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার ব্যাসের পাইপ। এ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আপত্তি দেয়। অভিযোগ রয়েছে, পাইপের ব্যাস কমিয়ে কম দামে পাইপ এনে ওই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে এসব পাইপ আটকে থাকে। পরে সেগুলোকেই ব্যবহারের জন্য নিয়ে আসা হয়। এ প্রসঙ্গে নতুন প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম সমকালকে জানান, তিনি নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন। এসব দুর্নীতির কথা জানা নেই তার। যে পাইপ আমদানি করা হয়েছিল, সেই পাইপই আনা হয়েছে। প্রকল্পটি কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেননি।

সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প (তৃতীয় পর্যায়): সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরুর কথা ছিল দ্বিতীয় শোধনাগারের কাজ শেষ হওয়ার আগেই। তিন বছর আগে দ্বিতীয় শোধনাগার উদ্বোধন করা হয়েছে। তৃতীয়টির কাজই শুরু হয়নি। এখন বলা হচ্ছে, এ প্রকল্পের জন্য চার হাজার কোটি টাকা খরচের হিসাব করা হলেও সম্ভাব্য ঋণদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। ডেনমার্ক টাকা দিতে আগ্রহী আছে। কিন্তু তারা নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ওয়াসার আরেক কর্মকর্তা জানান, প্রধান সমস্যা টাকা। দাতা সংস্থাগুলো যে অর্থ দেয়, তার সুদ দিতে হয়। দাতা সংস্থাগুলো সমীক্ষা করে তাদের লোকজন দিয়ে। কাজে তাই ধীরগতি দেখা দেয়।

ওয়াসার হিসাব মতে, বর্তমানে প্রতিদিন চাহিদার ২৪০ কোটি লিটার পানির ৭৮ শতাংশ ভূগর্ভস্থ থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে তোলা হয়। বাকি ২২ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থ ক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে পানীয় জলের চাহিদা পূরণ করা। প্রকল্পগুলোর বেহাল অবস্থার কারণে তা আর সম্ভব হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *