এক সারিতে ৪টি নতুন কবর

Slider গ্রাম বাংলা টপ নিউজ ফুলজান বিবির বাংলা বাংলার মুখোমুখি

uuk

 

এক সারিতে ৪টি নতুন কবর। তাজেল, জাকারিয়া, মনির, ইসমাইল -এরা কেউ কারও চাচাতো ভাই কিংবা খেলার সাথী। দুর্বৃত্তরা তাদের সকল খেলা থামিয়ে দিয়েছে। কবরস্থান থেকে মাইলখানেক দূরে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে এ চার শিশুর ঘরে কেবলই কান্নার রোল। মাটিচাপা লাশ উদ্ধারের পরদিন বৃহস্পতিবারও একই চিত্র। পাশাপাশি চারটি জীর্ণ ঘর, প্রতিটি ঘরেই এক দৃশ্য। সন্তান হারানোর বেদনায় পাগলপ্রায় মাকে কেউই কোনো সান্ত্বনা দিয়ে থামাতে পারছেন না।
কে বা কারা এমন পাষণ্ড, এত মায়ের চোখে জল এনে দিলো। সন্দেহের তীর গ্রামেরই এক প্রভাবশালী ব্যক্তির দিকে। ৮ পঞ্চায়েতের গ্রামে যিনি নিজেও এক পঞ্চায়েতের প্রধান। বাকি ৭ পঞ্চায়েতের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও আবদুল আলী তার পঞ্চায়েত নিয়ে একলাই চলতেন। সন্দেহের তীর সেই আবদুল আলীর দিকে। সাধারণের সন্দেহ ছড়িয়েছে পুলিশের মাঝেও। আবদুল আলী এখন তার দুই ছেলে নিয়ে পুলিশের খাঁচায় বন্দি। এর মধ্যে এক ছেলে জুয়েল মিয়াসহ তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। চার শিশুহত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন হবিগঞ্জের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাওসার আলম। বুধবার রাতেই এ দুজনকে আটক করা হয়। বৃহস্পতিবার আটক হন আবদুল আলীর আরেক ছেলে রুবেল মিয়া ও আরও তিন সন্দেহভাজন হাবিবুর রহমান আরজু, বাচ্চু মিয়া ও বশির মিয়া। পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মিজানুর রহমান গতকাল আবারও ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। ছিলেন অতিরিক্ত ডিআইজি ড. আক্কাস উদ্দিন ভুঁইয়া, হবিগঞ্জের এসপি জয়দেব ভদ্রও।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, আবদুল আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা অনেক ‘কীর্তিগাথা’র কারিগর। পুরনো দুটো হত্যাকাণ্ডে আবদুল আলীর সম্পৃক্ততার তথ্য জানা গেছে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে। ভাদেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মোতাসির মিয়ার ভাই মোশাহিদ হত্যার ঘটনায় মামলার আসামিও ছিলেন তিনি, যে ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯৫ সালে। বয়োবৃদ্ধরা স্মৃতি হাতড়ে জানালেন ২৫ বছর আগের জলিল হত্যা ঘটনার সঙ্গেও আবদুল আলীর সম্পৃক্ততার কথা। এর বাইরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণেও আবদুল আলী ও তার পরিবার গ্রামে আতঙ্কের কারণ। চাঁদা না পেয়ে গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয় একটি লেবুবাগান দখল করতে গিয়ে কদিন জেলও খেটে এসেছেন আবদুল আলী। কম যান না তার পরিবারের সদস্যরাও। তার ছেলে রুবেল আহমদ গত বছরের ৩১শে অক্টোবর ভাঙচুর চালান স্থানীয় ফয়জাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হারুন আল রশিদ জানান, রুবেলের বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ ছিল। সালিশের উদ্যোগ নিলে খেপে গিয়ে দলবল নিয়ে হামলা চালায় সে।
গত জানুয়ারিতে আবদুল আলীর অনুসারীদের সঙ্গে গ্রামের বাকি ৭ পঞ্চায়েতের নতুন করে আবারও বিরোধের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় মুরব্বি সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুল খালিক জানান, গ্রামের বাসিন্দা কাজল মিয়া, সাজিদ মিয়ার সঙ্গে তাদের চাচা রইসউল্লাহ’র জায়গা সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে নতুন করে গোষ্ঠীগত বিরোধের সৃষ্টি করেন আবদুল আলী। গ্রামবাসীর ধারণা, এ বিরোধের জেরেই আবদুল আলীর লোকজন হত্যা করেছে ৪ শিশুকে।
গ্রামের এক প্রান্তে লোকের আনাগোনা অন্য প্রান্তে চিত্র অন্যরকম। কোনো পুরুষের দেখা মেলেনি আবদুল আলীর বাড়ির আশপাশে। নারীরাও যেন নিজেদের ঘরে বন্দি করে রেখেছিলেন। কথা হয়, আবদুল আলীর বড় স্ত্রী হালিমা বেগমের সঙ্গে। তার দাবি, তার স্বামী ও সন্তানরা নির্দোষ। তাদের ফাঁসানো হয়েছে। তিনি বলেন, ছেলের এসএসসি পরীক্ষা চলছে তাকেও ছাড় দেয়া হয়নি। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আবদুল আলীর পুত্রবধূ তফিনা বেগম দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, তার শ্বশুরকে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি সন্দেহ করেন, বাকি ৭ পঞ্চায়েতের মধ্য থেকে কেউই এ ঘটনা ঘটিয়ে তাদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছে। তিনি তার শিশুকন্যার মাথায় হাত রেখে বলেন, তিনি জানেন তার শ্বশুর দোষী না। দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানান তিনিও।
চার শিশুর লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সম্পর্কে এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, শিশুদের শ্বাসরোধ করে হত্যা হয়েছে। সে হিসেবে অনেকেই ধারণা করছেন এ ঘটনা একজন বা দুজনে মিলে ঘটানো সম্ভব নয়। তাদের সন্দেহ, বড় একটি দলই সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুব হাসান মানবজমিনকে বলেন, অনেক বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সন্দেহ করার মতো অনেক কিছু আছে-সন্দেহের কারণও আছে। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। সকলেরই একটাই লক্ষ্য-প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা। র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, এই মুহূর্তে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা সবার সহযোগিতা চাই।
শিশু চারটি হারিয়ে গিয়েছিল গত শুক্রবার। খুঁজে খুঁজে হয়রান হওয়ার পর গত বুধবার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে ইছা বিলের গর্তে বালিচাপা লাশ মিলে চার শিশুর। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই শিশুদের স্বজনদের বুকে যে কান্না জমেছিল, লাশ উদ্ধারের পর তা যেন বাঁধ ভেঙে যায়। কেবলই কাঁদছেন তারা। বুকের কষ্ট বুকে চেপে রাখতে চাইলেও সে সুযোগ তারা পাচ্ছেন না। দর্শনার্থী-কৌতূহলীদের ভিড়ে, প্রশ্নে নীরবে দুই ফোঁটা জল ফেলতে পারছেন না। পুলিশ-মিডিয়ার আনাগোনায় ফুরসত নেই একটু দম ফেলারও। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখের জল ফুরিয়ে যাওয়ার যোগাড় তাও নিস্তার নেই। টিভি ক্যামেরাগুলো বাড়তি দুঃখের আবহ তৈরি করতে চোখের জলের ‘আবদার’ জানায়। ঘটনার পর বিভিন্ন সংবাদে মায়েদের দেখানো হয়ে যাওয়ায় নতুন মুখেরও সন্ধান করেন তারা। টিভি ক্যামেরার সামনে হাজির হতে হয় দাদি, খালা, চাচিদেরও। ‘হৃদয়স্পর্শী’ আবহের জন্য ঘর থেকে শিশুদের পড়ার বইগুলো এনে ফেলা হয় কান্নারত স্বজনদের কোলে। এতো আয়োজনের অবশ্য দরকার ছিল না। শিশুদের ঘরের দরজায় পা রাখলে এমনিতেই চোখের পাতা ভারি হয়, ঝাপসা হয়ে আসে। একেক জন মায়ের জলহীন চোখ, ভাষাহীন মুখ বুকের ভেতরে আঘাত করবে যে কারোরই।
কান্নাভেজা বাতাস যেন বইছে পুরো সুন্দ্রাটিকিতে। আর আছে সন্দেহ-অবিশ্বাস। কেউ কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ভরসা রাখার সাহসও যেন তারা হারিয়ে ফেলেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *