সাম্প্রতিক সন্ত্রাস এবং আমাদের শিক্ষিত জনমানস

বাধ ভাঙ্গা মত
untitled-24_174749
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ঢাকায় এক বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হচ্ছিল। তিনি উচ্চশিক্ষিত, আধুনিকমনা এবং ঢাকায় সুশীল সমাজের একজন বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য। তার সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। ষাটের দশকের গোড়ায় তার সঙ্গে একত্রে ঢাকার রাস্তায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী মিছিল করেছি। আমি লন্ডনে চলে আসার পরও তার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হয়। দেশের অবস্থা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করি। আমাদের রাজনৈতিক মতামতও পরস্পরের অনেকটা কাছাকাছি।

সম্প্রতি দিনাজপুরে পিয়েরো পারোলারি নামের দ্বিতীয় ইতালির নাগরিক (তৃতীয় বিদেশি নাগরিক) সন্ত্রাসীদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে ঢাকায় ওই বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করছিলাম। অপর দু’জন বিদেশি নাগরিকের মতো এই বিদেশি পাদ্রি এবং ডাক্তারের ওপর হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে আইএস। তাদের মুখপত্র ‘ডাবিকেও’ নাকি রয়েছে যে বাংলাদেশের দিকে তাদের নজর থাকার কথা। যদিও বাংলাদেশ সরকার বলছে, বাংলাদেশে আইএস নেই।
যদি বাংলাদেশে আইএস না থাকে, তাহলে এই সন্ত্রাস যারা ঘটাচ্ছে বলে অনুমান করা যায়, সেই জামায়াত-শিবির ও ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সন্ত্রাসকে কভার দেওয়ার জন্য বহুদূরে বসে আইএস এই স্বীকারোক্তি প্রচার করছে কি-না, সে সম্পর্কেও ঢাকার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে ঢাকায় মুক্তমনা ব্লগার হত্যার কথাও এসে গেল। তাকে বললাম, এ ধরনের উপর্যুপরি বুদ্ধিজীবী হত্যা তো কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশ মেনে নিতে পারে না।
বন্ধু আমার কথায় তেমন সায় দিলেন না। মিনমিনে গলায় বললেন, ‘তাই বলে তো ধর্মের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক লেখাকেও সমর্থন করা যায় না। এই ব্লগারেরা ধর্মের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক লেখা না লিখলেই পারে।’ আমি তার কথা শুনে স্তম্ভিত হলাম। এটা তো সেই ষাটের দশকের প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানুষটির কণ্ঠস্বর নয়। তাকে বললাম, আপনি অভিজিৎ কিংবা অন্য যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের লেখা কি পড়েছেন? তারা ধর্মকে আঘাত করেননি। ধর্মান্ধতা কীভাবে সমাজ প্রগতি ও বিজ্ঞানের সত্যের বিকাশকে বাধা দেয়, তা দেখিয়েছেন। এ ধরনের মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চা ও আলোচনা ছাড়া তো কোনো দেশ ও সমাজ এগোতে পারে না; বরং মধ্যযুগীয় কূপমণ্ডূকতায় দেশ ও সমাজ একেবারে পশ্চাৎমুখী হয়ে পড়বে।
তিনি আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন বলে মনে হলো না। বললেন, ‘যারা সরাসরি নাস্তিকতা এবং ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করে, তাদের এই পাল্টা আঘাত খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতেই হবে।’ শুধু এই বন্ধু নন, দেশের এককালের প্রগতিমনা আরও অনেক বন্ধু ও বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, তারা বর্তমানের নির্মম ব্লগার হত্যার ঘটনাকে ততটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে চান না। ব্লগার হত্যার জন্য ঘাতকরা যতটা দায়ী, ব্লগাররা নিজেরাও ততটা দায়ী বলে তারা মনে করেন। বিস্ময়ের কথা, আমাদের বর্তমান গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার সরকারেরও একশ্রেণীর নেতা ও মন্ত্রীর মধ্যে এই একই ধারণা বিরাজ করছে।
আমার মনে হয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের শিক্ষিত ও আধুনিকমনা সমাজ-মানসেও এক বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। বামপন্থিরা ডানপন্থি হয়েছেন, ডানপন্থিরা আরও কট্টর রক্ষণশীল হয়েছেন। ধর্মীয় উদারতা, সহিষ্ণুতা ব্যাপকভাবে লোপ পেয়েছে এবং তার স্থান দখল করেছে ধর্মীয় সংকীর্ণতা, ধর্মান্ধতা এবং প্রচণ্ড অসহিষ্ণুতা। ফলে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা সমাজজীবনে গতি ও শক্তি হারাচ্ছে।
যে আধুনিক সমাজ-শক্তি পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেই শক্তি এখন আরও ভয়াবহ ধর্মান্ধতার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনিচ্ছুক। বর্তমান সন্ত্রাসীরাও সমাজের বাইরের কোনো লোক নয়। কিন্তু সমাজ তাদের চিহ্নিত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অনেকটাই যেন অনাগ্রহী। দুষ্কৃতকারীরা তাই এক ধরনের প্রচ্ছন্ন আশ্রয় পাচ্ছে সমাজের ভেতরেই। আইনের হাত যেখানে সহজে পেঁৗছাতে পারে না।
পাকিস্তান ছিল ধর্মীয় কাঠামোর রাষ্ট্র। কিন্তু সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ঘাতকের মূর্তি ধারণ করতে পারেনি। পাকিস্তান আমলেরও আগে লেখা আবুল মনসুর আহমদের ‘হুজুর কেবলার’ মতো গল্প বা পরবর্তীকালে আরজ আলী মাতুব্বরের ধর্মবিষয়ক লেখা ও দর্শন শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম সমাজ গ্রহণ করেছে। তাদের দেশত্যাগ করতে হয়নি। অথবা ধর্মান্ধ জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে নির্মম মৃত্যুবরণ করতে হয়নি। কিন্তু গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে একটি মাত্র কবিতায় মহানবীর (দ.) নাম উল্লেখ করায় প্রাণনাশের হুমকির মুখে কবি দাউদ হায়দারকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। তিনি ক্ষমা চেয়েও ক্ষমা পাননি। আজও বিদেশেই বসবাস করছেন।
আবুল মনসুর আহমদের ‘হুজুর কেবলা’ গল্পের কাছে হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন’ উপন্যাসটি নস্যি। ‘হুজুর কেবলা’ লিখে আবুল মনসুর আহমদের জীবন বিপন্ন হয়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলায় হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির আঘাত সহ্য করতে হয়েছে এবং পরিণতিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যাকে মুসলিম জাগরণের কবি বলা হয়, মোল্লা-মৌলভিদের নিয়ে স্যাটায়ার এবং শ্যামাসঙ্গীত ও কীর্তন লেখার জন্য ধর্মদ্রোহী ও কাফের আখ্যা পেয়েছিলেন। কিন্তু সে জন্য ঘাতকের চাপাতি তার মাথায় উদ্যত হয়নি।
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন একজন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে ঢাকায় একশ্রেণীর গোঁড়া মতাবলম্বী সাহিত্যিক দাবি তুলেছিলেন, নাস্তিকতাবাদকে সাহিত্যে বর্জন করা হোক। তার জবাবে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের এক সভায় মওলানা আকরম খাঁ ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘নাস্তিকতাবাদ যদি প্রকৃত বাণীমূর্তি ধারণ করে, তাহলে তাকেও আমাদের সাহিত্যে স্থান দিতে হবে।’
এ বক্তব্য ছাড়াও তিনি পবিত্র কোরআনের তফসির ও মোস্তফা চরিত নামে যে দুটি মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তাতে ইসলামের অনেক ধ্যান-ধারণা ও তথ্যের বিপরীত কথা রয়েছে। এ জন্য তাকে ঢাকার লালবাগ মসজিদ থেকে সে সময় ধর্মদ্রোহী ও মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তার কোরআনের তফসির পাঠ মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। তাতে গ্রন্থ দুটির বিক্রি ও প্রচার কমেনি এবং মওলানা সাহেবের জীবননাশের হুমকিও কেউ দেয়নি। মওলানা আকরম খাঁ নিজেও সুনি্ন ছিলেন না, ছিলেন ‘লা মজহাবি’।
আমি অতীতের প্রসঙ্গটা এ জন্যই টানলাম যে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের চেয়েও বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে মুসলিম শিক্ষিত সমাজ আধুনিক চেতনা থেকে যতটা পিছিয়েছে, তা এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হবে। আমাদের জাগতিক ও বৈষয়িক উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে মধ্যযুগীয় অন্ধ চিন্তা ও অসহিষ্ণুতার দিকে পিছিয়েছি। এ ধরনের অন্ধ সমাজেই অসহিষ্ণুতা ও কুসংস্কার বাড়ে এবং ধর্মান্ধতা ফ্যাসিবাদী ঘাতক চরিত্রের রূপ ধারণ করে।
কোনো সমাজে যখন ধর্মান্ধতা দেখা দেয়, তখনতা ধর্মান্ধতা থেকে জেগে ওঠা ঘাতক শক্তিকেও নিজের অজান্তেই প্রশ্রয় দেয়। বাংলাদেশেও আজ এই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা দেখা দিয়েছে। এই লেখার শুরুতেই আমার যে এককালের আধুনিকমনা শিক্ষিত বন্ধুর কথা উল্লেখ করেছি, তার এবং তার মতো আরও কয়েকজনের মন-মানসিকতার বিস্ময়কর পরিবর্তন এবং তাদের মধ্যে নিহত ব্লগার ও তার ঘাতকদের একই পাল্লায় তুলে মাপার প্রবণতা দেখে বুঝতে কষ্ট হয়নি, আমাদের শিক্ষিত ও আধুনিক সমাজ-মানসেও কী ভয়ানক অধোগতি ঘটেছে। এ ধরনের সমাজেই আক্রমণকারী ও আক্রান্তকে সমদোষে দোষী ভাবা সম্ভব।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সন্ত্রাস দমনের জন্য কেউ কেউ জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ভাবেন। এটা সত্য, কেবল পুলিশ দ্বারা সরকার এই সন্ত্রাস দমন করতে পারবে না। এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জনমত এবং জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই সন্ত্রাসীদের জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু তা করা সম্ভব হবে না, যতদিন পর্যন্ত এই জনসমাজের একটা বড় এবং প্রভাবশালী অংশের মধ্য থেকে সন্ত্রাসীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সহানুভূতির ভাব দূর করে প্রচণ্ড ঘৃণার ভাব তৈরি করা না যাবে।
সরকারকে এবং দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামতে হবে। প্রচারকার্যে উদ্যোগী হতে হবে। ধর্ম ও ধর্মান্ধতা যে এক নয় এবং বর্তমান সন্ত্রাসীরা ধর্মের নাম ভাঙালেও তারা যে ধর্মের শত্রু_ এই সত্যটা দেশের নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছে ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে। মসজিদে, মাদ্রাসায়, স্কুল-কলেজে সর্বত্র এই প্রচার অভিযান চালাতে হবে। পাশাপাশি সন্ত্রাসের সঙ্গে আপস নয়, অবিরাম আঘাত হানার নীতি সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। এই সন্ত্রাস থেকে দেশকে এবং রাজনীতিকে মুক্ত করা না গেলে কোনো অর্থনৈতিক উন্নতিই বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *