উপমন্ত্রী নিজেই যুগ্ম সচিবের কক্ষ তছনছ করলেন  

Slider টপ নিউজ

99560_f1

 

যুব দিবসের অনুষ্ঠানের ব্যানারে নাম ছিল না। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে যুগ্ম সচিবের কক্ষে চড়াও হলেন উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। নিজেই টেবিলের কাচ, কম্পিউটার, টেফিফোন সেট তছনছ করেন। ছুড়ে ফেলে দেন ফাইলপত্র। তালা লাগিয়ে দেন এক সহকারী সচিবের কক্ষে। একজন মন্ত্রীর এমন কর্মকাণ্ডে বিস্মিত হয়েছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঘটনার পর পুরো সচিবালয়জুড়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। যদিও আরিফ খান জয় জানিয়েছেন ভুল বোঝাবুঝি থেকে এ ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল বেলা ১২টায় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে এ ঘটনা ঘটে। ওই সময় মন্ত্রণালয়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে যুব দিবসের অনুষ্ঠানে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এদিন বেলা ১০টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ছিল জাতীয় যুব দিবস- ২০১৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার ও বিশেষ অতিথি ছিলেন একই মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রী আরিফ খান জয়। এতে সভাপতিত্ব করেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব নূর মোহাম্মদ। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বেলা সাড়ে দশটায় অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পর উপ-মন্ত্রী জয় পেছনে থাকা ব্যানারে নিজের নাম আছে কি না খেয়াল করেন। ব্যানারে নিজের নাম না দেখে চেয়ার থেকে উঠে পড়েন এবং চেঁচিয়ে কিছু বলতে শুরু করেন। এ সময় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীরেন সিকদার, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল, সচিব নূর মোহাম্মদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিছুটা চমকে যান। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ওসমানি মিলনায়নের স্টেজ থেকে নিচে নেমে আসেন উপ-মন্ত্রী জয় এবং বলতে থাকেন, আমার মন্ত্রণালয়ে জামায়াত-বিএনপির কর্মকর্তারা ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তাদের আশ্রয়-প্রশয় দিচ্ছে কেউ কেউ। ওদের কারণে কাজ-কর্মের কোন ঠিকানা নেই। তারা কেন ব্যানারে আমার নাম রাখল না। এ সময় সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং যুব ও ক্রীড়া সচিব জয়ের কাছে এসে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। উপ-মন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে সচিব বলেন, ব্যানারে আপনার নাম না রাখার বিষয়টি ভুল হয়েছে। এ ঘটনার জন্য কেউ দায়ী হলে অফিসে ফিরেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংসদীয় কমিটির সভাপতিও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিছুটা স্থির হয়ে পাঁচ মিনিট পর উপ-মন্ত্রী আবার মঞ্চে গিয়ে বসেন। এ সময় তার জন্য নির্ধারিত বক্তৃতা পর্বে তিনি অংশ নেন। পাশাপাশি ১৫ জন সফল যুবক ও যুব সংগঠনকে পুরস্কার দেয়ার সময় মঞ্চে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দ্বিতীয় দফা চিৎকার করতে করতে উপ-মন্ত্রী জয় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। সঙ্গে ছিল তার গানম্যানসহ কয়েক জন। এ সময় তাকে কেউ রুখতে পারেনি। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন থেকে সোজা নিজ মন্ত্রণালয়ে যান জয়। লিফট থেকে নেমেই যুগ্ম সচিব (যুব) মো. মাশুক মিয়ার ৫০১ নম্বর কক্ষে ঢুকে পড়েন। উপ-মন্ত্রীকে দেখে যুগ্ম সচিবের কর্মচারীরা হতচকিত হয়ে পড়েন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুমের কম্পিউটারের মনিটর নিচে ফেলে দেন। এরপর টেবিলে থাকা টেলিফোন, ফাইল ও কাগজপত্র নিচে ফেলতে থাকেন।
এ কাজে তার গানম্যান ও অপরিচিত একজন সহায়তা করেন। উপ-মন্ত্রী বলতে থাকেন, জামায়াত-বিএনপির কর্মচারীরা সরকারকে শেষ করে দিচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করার এখনই সময়। উপ-মন্ত্রীর এমন কর্মকাণ্ড চলার সময় কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার সামনে আসতে সাহস পায়নি। যুগ্ম সচিবের রুম থেকে বেরিয়ে জয় ৫০৭ নম্বর রুমের সামনে গিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ গোলাম কবিরকে খুঁজতে থাকেন। এ সময় গোলাম কবির ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের অনুষ্ঠানস্থলে থাকায় তাকে পাননি। পরে উপ-মন্ত্রী জয় রুমটিতে তালা লাগিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। তার কথামতো রুমটিতে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এ কারণে গতকাল ৫০৭ নন্বর রুমে বসে দায়িত্ব পালনকারী সিনিয়র সহকারী সচিব মো. সালাহউদ্দিন আহাম্মদ, সহকারী প্রধান মোহাম্মদ সেলিম হোসেন, সিনিয়র সহকারী সচিব গোলাম কবির ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা আফরোজা বেগম অফিস করতে পারেননি। এ চার কর্মকর্তা অফিসে এসে ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে অনেকটা ভীতু হয়ে অফিস ত্যাগ করেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে যুব ও ক্রীড়া উপ- মন্ত্রী আরিফ খান জয় মানবজমিনকে বলেন, কারও রুম তছনছ বা তালা দেয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। যা কিছু হয়েছে তা সাময়িক ভুল  বোঝাবুঝি। তবে ঘটনার বিষয়টি স্বীকার করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব নূর মোহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, আগামী সপ্তাহেই অবসরে যাচ্ছি। আমার শেষ সময়ে বিষয়টা এমন হওয়ার কথা ছিল না। একজন সিনিয়র অফিসার এভাবে অপদস্ত হলে তার মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় আপনারাই বলুন? সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দুপুরে অফিসে এসে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও সচিব পুরো ঘটনা জানতে পারেন। এ সময় যুগ্ম সচিব মাশুক মিয়াকে বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তিনি সচিব বা প্রতিমন্ত্রীর কাছে কিছু বলতে পারছিলেন না। প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের পরামর্শে তিনি বাসায় চলে যান। এরপরই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের জানানো হয়। তবে উপ-মন্ত্রী জয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোন সাড়া পাননি বলে জানা গেছে।
২২ মাস ধরেই বনিবনা হচ্ছে না: ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী পদে বীরেন সিকদার ও উপ-মন্ত্রী হিসেবে আরিফ খান জয় দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। কারণ জয় চাচ্ছিলেন সব ফাইল যেন তার হয়ে প্রতিমন্ত্রীর কাছে যায়। এ বিষয়ে কয়েকবার প্রতিমন্ত্রী ও সচিবকে জানালেও তাদের পক্ষ থেকে রুলস অব বিজনেসে উল্লেখ করা উপ-মন্ত্রীর দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী উপ-মন্ত্রীকে ক্ষমতা দেয়ার কোন আদেশ জারি করলেই শুধু তা কার্যকর হবে। কিন্তু ২২ মাস ধরে তার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। এ কারণে প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রীর সম্পর্ক বেশ খারাপ।
তছনছের ঘটনায় কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ: প্রশাসনের ৮৫ ব্যাচের সিনিয়র এক কর্মকর্তার রুম তছনছের কারণে গতকাল দেশের প্রশাসনযন্ত্র সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। অনেক কর্মকর্তা এনিয়ে নিজেদের প্রতিক্রিয়া সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে প্রকাশ করেন। ব্যাচমেটরা একে অপরের কাছে গিয়ে নিজেদের দুঃখ ভাগাভাগি করেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত মো. মাশুক মিয়া। তার ব্যাচের কর্মকর্তারা জানান, ৮৫ ব্যাচের যে কজন ভালমানের কর্মকর্তা রয়েছেন মাশুক মিয়া তাদের মধ্যে একজন। এর আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন এ যুগ্ম- সচিব। মাশুক মিয়া সম্পর্কে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব নূর মোহাম্মদ মানবজমিনকে জানান, মাশুক মিয়া ব্রিলিয়ান্ট অফিসার। কাজ-কর্মেও বেশ দক্ষ তিনি।
টাকা ব্যয়ে ব্যর্থতা, ৫০ কোটি টাকা নিয়ে টানাটানি: গেল অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের অর্থ নিয়ে রীতিমতো টানাটানি হয়েছে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং উপ-মন্ত্রীর মধ্যে। এ কারণে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করা যায়নি। কারণ প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রী নিজেরাই চেয়েছিলেন নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে অর্থ খরচ করতে। কিন্তু তা পারেননি। এ কারণে বর্তমান অর্থবছরে অর্থ ফেরত যাতে দিতে না হয় এজন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব আগেভাগেই উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই মধ্যে থোক বরাদ্দের অর্থ চেয়ে অর্থ বিভাগে চিঠি দিয়েছেন। এছাড়া বরাদ্দকৃত অর্থ কোথায় কোথায় খরচ করা হবে এবং কী কী প্রকল্প গ্রহণ করা হবে তার একটি তালিকা তৈরি করেছেন। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিষয়টি বেশ ভালোভাবে এবার মনিটরিং করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ব্যানারে জয়ের নাম নেই, ভুল স্বীকার করছে মন্ত্রণালয়: জাতীয় যুব দিবসের অনুষ্ঠানের ব্যানারে উপ-মন্ত্রী আরিফ খান জয়ের নাম না লেখার বিষয়টি স্বীকার করছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রতি বছর যুব দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার তিনি প্রধান অতিথি থাকতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। প্রতি বছর ব্যানারেই শুধু প্রধান অতিথির নাম লেখা হয়। সেখানে অন্য কারও নাম থাকে না। গত বছরও প্রধানমন্ত্রী সময় দিতে না পারায় প্রধান অতিথি হিসেবে শুধু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের নাম ছিল। এবারও ওইভাবেই প্রধান অতিথির নাম লেখা হয়েছে। বিষয়টি সর্ম্পকে জানতে চাইলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব নূর মোহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, আমি মনে করি উপ-মন্ত্রীর নাম লেখাটা অনিচ্ছাকৃত ভুল। তবে ভুলের বিষয়টি আমরা স্বীকারও করেছি। অনুষ্ঠানের আগ মুহূর্তে বিষয়টি আমাদের নজরে আসলেও তখন সংশোধন করার উপায় ছিল না।
জয়ের অভিযোগ: যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় নিয়ে উপ- মন্ত্রী আরিফ খান জয়ের অভিযোগ, মন্ত্রণালয়ের কোন কর্মকাণ্ডে তাকে ঠিকভাবে রাখা হয় না। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও নিয়োগের ফাইলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তার কাছে পাঠানো হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *