প্রাণোচ্ছল ভবনে শ্মশানের নীরবতা, ‘সরু সিঁড়ি’র ভবনটি যেমন ছিল

Slider জাতীয়

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জন নিহত হয়েছেন। দগ্ধ ১২ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ভবনটিতে ২টি লিফট ও একটি সরু সিঁড়ি ছিল। তবে জরুরি ফায়ার এক্সিট ছিল না। ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ও লোকজন বের হওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বেশি প্রাণহানি ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র ও ভবনটির রেস্টুরেন্টগুলোতে বিভিন্ন সময়ে খেতে যাওয়া অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে প্রবেশ করার রাস্তা ছিল মাত্র একটি। সেটি নিচ তলার চায়ের চুমুক নামে একটি রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে। নিচ তলায় রয়েছে দুটি লিফট ও একটি সরু সিঁড়ি। আর সিঁড়িটি এত সরু যে সেখান দিয়ে চারজন লোক এক সঙ্গে ওঠা-নামা করা যায় না। উপর থেকে একজন এবং নিচ থেকে একজন করে ওঠা-নামা করা যায়।
এ বিষয়ে ওই ভবনে মাঝে মাঝে খেতে যাওয়া সাব্বির নামে এক তরুণ বলেন, সিঁড়িটি এত সরু যে দুইয়ের অধিক মানুষ একসঙ্গে উপরে উঠতে গেলে কিংবা নামতে গেলে সমস্যা হয়।

ভবনের ফ্লোরে ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট

গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি বেইলি রোডের সবচেয়ে জমজমাট ভবন। সাততলা ভবনটির অধিকাংশ ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট আছে। ফলে সারাদিনই সেখানে মানুষের যাতায়াত ছিল। তবে সন্ধ্যার পর মানুষের উপস্থিতি থাকত বেশি। বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে ৫০ শতাংশ ছাড় ছিল। ফলে সেখানে কাস্টমার বা অতিথি উপস্থিতি বেশি ছিল।

ভবনের প্রথম তলায় চায়ের চুমুক রেস্টুরেন্ট ছিল। এছাড়া ছিল গ্যাজট অ্যান্ড গিয়ার, স্যামসাং, শেখ হোলিক ও ওয়াফে বে নামে চারটি শোরুম। দ্বিতীয় তলার পুরোটা জুড়ে ছিল কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট। তৃতীয় তলায় ইলিয়ানের পাঞ্জাবির শোরুম। চতুর্থ তলায় খানাস নামে একটি রেস্টুরেন্ট, পঞ্চম তলায় পিৎজা হাট, ষষ্ঠ তলায় স্টিট ওভেন ও জেস্টি নামে দুটি রেস্টুরেন্ট এবং সপ্তম তলায় ফোকুস ও হাক্কা ডাকা নামে দুটি রেস্টুরেন্ট ছিল। এছাড়া ভবনটির ছাদেও এম্বোশিয়া নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল।

বেশি প্রাণহানি কাচ্চি ভাইয়ে

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, আগুনে হতাহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে। এ রেস্টুরেন্ট থেকে কমপক্ষে ১৫টির বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ভবনের ৪টি ফ্লোর থেকে মরদেহ উদ্ধার করি। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলা থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয় দ্বিতীয় তলার কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট থেকে।

কাচ্চি ভাই থেকে বেশি মরদেহ উদ্ধারের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে কোনো ধরনের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না। ঘটনার সময় সেখানে মানুষের উপস্থিতও ছিল বেশি। ভেন্টিলেশন না থাকায় ধোঁয়া বের হতে পারেনি। ফলে দম বন্ধ হয়ে তারা মারা যান।

রেস্টুরেন্টের জন্য অনুমতি ছিল না গ্রিন কোজি কটেজের

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গ্রিন কোজি কোটেজ নামে ভবনটির ডেভেলপার আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ। ভবনটির সব ফ্লোর ব্যবহার হচ্ছিল বাণিজ্যিকভাবে। তবে রেস্টুরেন্টের জন্য ব্যবহারের কোনো অনুমতি ছিল না এই ভবনের।

আজ (শুক্রবার) সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত রাজউক বলতে পারবে। তবে আমরা আমাদের তদন্তে এসব বিষয় যাচাই করব।

আগুনের সূত্রপাত চায়ের চুমুক থেকে

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ভবনটির নিচ তলায় চায়ের চুমুক নামে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। পরে সারা ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র এক মাস আগে ভবনটির নিচ তলায় এই রেস্টুরেন্টটি যাত্রা শুরু করে।

মো. নাবিল নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আমার বাসা শান্তিনগরে। প্রায় প্রতিদিন আমার আসা হয় বেইলি রোডে। গতকাল রাতে আমি এখানে পাঞ্জাবি কিনতে আসি। রাত ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে দেখি চায়ের চুমুক নামে রেস্টুরেন্টের এক কর্মচারী চুলায় যেন কী করছেন। পরে হঠাৎ দেখি গ্যাসের চুলায় আগুন লেগে যায়। তখন নিচে থাকা অনেকে আগুন নেভাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। দ্রুত আগুন সারা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।

দুলাল হোসেন নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, প্রথমে এসে দেখি নিচে চায়ের চুমুকে ছোট একটি আগুন লেগেছে। তখন রেস্টুরেন্টটির কর্মচারীরা এবং একজন পুলিশ সদস্য আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা কোনোভাবেই আগুন নেভাতে পারেননি। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন ভবনটিতে ছড়িয়ে পড়ে। চায়ের চুমুক রেস্টুরেন্টটি মাত্র এক মাস আগে যাত্রা শুরু করে।

বেইলি রোডের সবচেয়ে জমজমাট ভবনটি এখন ‘শ্মশান’

বেইলি রোডের সবচেয়ে জমজমাট ভবন গ্রিন কোজি কটেজ এখন ‘শ্মশানে’ পরিণত হয়েছে। ভবনটির প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট থাকায় সব সময় গমগম থাকত। কিন্তু গতকালের অগ্নিকাণ্ডে ভবনটির পুরো চিত্র পাল্টে গেছে। অগ্নিকাণ্ডের পর এখন ভবনটি দেখলে কারোরই বোঝার কথা নয় যে গতকালও এখানে কতটা জমজমাট ছিল।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও শান্তিনগরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বেইলি রোডে আসি। বেইলি রোডের জমজমাট ভবনটি হলো ‘কাচ্চি ভাই ভবন’ নামে পরিচিতি পাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ। রেস্টুরেন্ট বেশি থাকায় সন্ধ্যার পর প্রতিদিন অনেক মানুষের যাতায়াত ছিল ওই ভবনে। ভবনের নিচে থাকা চায়ের চুমুক নামে রেস্টুরেন্ট-এ লেগে থাকত মানুষের আড্ডা। আজ সেই সব আড্ডাও বুঝি পুড়ে গেল!।

গাফিলতির খোঁজে ফায়ার সার্ভিসের কমিটি

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে কারো গাফিলতি ছিল কি না তা তদন্ত করে দেখবে ফায়ার সার্ভিস। আজ (শুক্রবার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, অগ্নিকাণ্ডে অনেকে মারা গেছেন। এই মৃত্যু কাম্য নয়। এই মৃত্যু কখনো মেনে নেওয়া যায় না। এই ভবনটাতে একটা মাত্র সিঁড়ি আছে। ধোঁয়ার কারণে মানুষ যেখানে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। সেখানে কোনো ধরনের ভেন্টিলেশন ছিল না। আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি, আমরা আসলে দেখতে চাই কারো কোনো গাফিলতি ছিল কি না।

তিনি বলেন, এই ভবনে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল কি না আমরা তদন্ত করে দেখতে চাই। এছাড়া ভবন নির্মাণ করতে অন্য যেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমতি লাগে তা ছিল কি না সেটাও আমরা তদন্ত করে দেখব। আমরা তদন্তে দেখতে পাব কীভাবে আগুন লেগেছে এবং এখানে কারো কোনো গাফিলতি ছিল কি না।

ভবনটিতে অফিস করার অনুমতি ছিল কিন্তু সেটা না করে রেস্টুরেন্টসহ দোকান করা হয়েছে। এ অভিযোগের বিষয়ে মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, আমরা শুধু ফায়ার সেইফটি প্ল্যানটা দেখি। এ বিষয়ে রাজউক বলতে পারবে। তবে এ বিষয়টি আমরাও তদন্ত করে দেখব।

তিনি আরও বলেন, এই ভবনটাকে ইতোপূর্বে ফায়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা মনে করি যারা ব্যবসা করেন তাদের সবাইকে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার।

আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল নিচ তলা থেকে। আমাদের প্রাথমিক ধারণা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।

ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন ছিল জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, এই ভবনে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সেইফটি প্ল্যান ছিল না। ভবনে আমরা দুয়েকটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখতে পেয়েছি। ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি রয়েছে। মানুষ যে কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে একটি জানালাও ছিল না। এছাড়া চার তলায় অনেক গ্যাস সিলিন্ডার ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *