বিশ্ব ইজতেমায় আলমী শূরার আজ আখেরী মোনাজাত

Slider জাতীয়
Exif_JPEG_420

টঙ্গী: ইজতেমা ময়দান থেকে: দুনিয়া ও আখেরাতের বড় সম্পদ হলো ঈমান ও আমল। এই ইমান ও আমল মজবুত করতে আল্লাহর দিদার লাভের আশায় রাত দিন ইবাদত বন্দেগীর মধ্য দিয়ে বিশ^ ইজতেমার দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। আজ রবিবার আখেরী মোনাজাত। সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টা মধ্যে আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে এবং ইজতেমা এলাকায় শনিবার রাত ১২টা থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকবে, বলে জনিয়েছেন জিএমপি কমিশনার মাহবুব আলম। তাবলীগ জামাত বাংলাদেশের শীর্ষ মুরুব্বি, কাকরাইল জামে মসজিদের পেশ ইমাম ও খতীব মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করবেন।
গতকাল শনিবার বিকেলে বিশ^ ইজতেমা ময়দানে স্থাপিত বিদেশী মেহমানদের জন্য তৈরী করা গাজীপুর মহানগর পুলিশের নিয়ন্ত্রন কক্ষের সামনে সাংবাদিকদের জিএমপি কমিশনার মাহবুব আলম এ কথা বলেন।

কমিশনার বলেন, শনিবার রাত ১২টা থেকে টঙ্গী-কামারপাড়া রোড, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে গাজীপুরের ভোগরা বাইপাস পর্যন্ত এবং আবদুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া ময়মনসিংহ ও গাজীপুরগামী যানবাহনগুলোকে গাবতলী দিয়ে কোনাবাড়ি হয়ে এবং ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী যানবাহনগুলোকে ভোগরা বাইপাস দিয়ে ৩শ’ ফিট রাস্তা ব্যবহার করে চলাচল করতে বলা হয়েছে। এসময় এসব সড়ক হয়ে কোনো পণ্যবাহী গাড়ি যান চলতে দেওয়া হবে না। তবে ইজতেমা সংশ্লিষ্ট সব ধরনের যান চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। তিনি বলেন, ইজতেমার মুরুব্বীদের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, আজ রবিবার সকাল ৯টা থেকে সাড়ে নয়টা মধ্যে আখেরী মোনাজাত করবেন।
বয়ান: গতকাল শনিবার বাদ ফজর বয়ান করেন মুম্বাইয়ে মাওলানা আব্দুর রহমান হাফিঃ। বাদ যোহর মাওলানা ইসমাইল হাফিঃ ( গোধরা)। বাদ আছর ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাছান হাফিঃ। বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা হাফিঃ বয়ান করেন। আজ রবিবার আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব।
বয়ানে যা বলা হয়েছে:

মাওলানা আব্দুর রহমান হাফিঃ ইমান, আমল, জাহান্নাম, জান্নাত ও দাওয়াতে মেহনতের উপর গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। তিনি বলেন, আল্লাহজাল্লাহ শানহু কোরআনে পাকের আয়াতগুলোর মাধ্যমে এই উম্মতের শান-মর্যাদা, জিম্মাদারি ও জিন্দেগীর মাকসাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। উম্মতকে যে জিম্মাদারি দেয়া হয়েছে তার মূল্য সাহাবায়ে আজমাঈন বুঝতেন। তাই তারা সর্বদিকে এই দাওয়াতের জিম্মাদারি পৌছে দেয়ার জন্য পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণসহ সারা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়তেন। সাহাবায়ে আজমাঈনগণ তাদের জান ও মাল দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করতেন। তাই আল্লাহজাল্লাহ শানহু প্রতি কদমে কদমে তাদের সাহায্য করতেন। তিনি আরও বলেন, দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ঈমান-আমল। ঈমান ও আমলের উপর আল্লাহজাল্লাহ শানহু দুনিয়ার শান্তির ব্যবস্থা করেন। ঈমান ও আমল দ্বারাই দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবী হাসিল হয়। তিনি বলেন, যার কাছে ধনসম্পদ নেই, আমরা তাকে মিসকিন বা ফকির বলি। কিন্তু প্রকৃত মিসকিন বা ফকির হলো সেই ব্যক্তি যার কাছে কালেমা নাই। যার কাছে বেহেশতে যাওয়ার সামানা নাই, সেই হলো প্রকৃত ফকির। যার মধ্যে কলেমা আছে সেই ধনী ও ভাগ্যবান। তিনি বলেন, দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের কাছে কলেমার দাওয়াত পৌছানো আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। কালেমা ছাড়া কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না।
বধিরদের জন্য বয়ান: বিশ্ব ইজতেমায় আগত বধির (কানে শোনে না এমন) মুসলি¬দের জন্য তুরাগ নদীর পশ্চিম পাড়ে নির্ধারিত খিত্তায় জামাতবদ্ধ করে বয়ান শোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় ইশারা ভাষায় ইঙ্গিতের মাধ্যমে বয়ান বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

ইজতেমায় সাত মুসল্লি সহ ১০ জনের মৃত্যু: বিশ্ব ইজতেমায় আরো তিন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দ্বিতীয় দিন বিকেল পর্যন্ত একজন পুলিশ সদস্য সহ দশ জনের মৃত্যু হল । এর মধ্যে ইজতেমা ময়দানে সাত জন, ময়দানে আসার পথে একজন পুলিশ সদস্য সহ তিনজন নিয়ে মোট দশ জন মারা গেলেন। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার সকাল বিকেল পর্যন্ত তিন জন মারা যান। এই তিন জন হলেন, শেরপুর জেলা সদরের জুগনিবা গ্রামের মৃত সমশের আলীর ছেলে নওশের আলী (৬৫), ভোলা জেলার পরাগগঞ্জ থানার সামানদার গ্রামের বেলায়েত হোসেনের ছেলে আ. কাদের (৫৫) ও নেত্রকোনা সদরের কালিয়াঝুড়ি এলাকার হোসেন আহম্মদের ছেলে স্বাধীন (৪৫)। এর আগে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে মারা যাওয়া চার মুসল্লি হলেন- নেত্রকোনা থানার কুমারী বাজার গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে আবদুস সাত্তার (৭০), একই জেলার বুড়িঝুড়ি গ্রামের স্বল্পদুগিয়া গ্রামের আব্দুস ছোবাহানের ছেলে এখলাস মিয়া (৬৮), ভোলা জেলার ভোল্লা গ্রামের নজির আহমেদের ছেলে শাহ আলম (৬০), জামালপুর জেলার তুলশীপুর এলাকার পাকুল্লা গ্রামের হযরত আলীর ছেলে মতিউর রহমান (৬০)।
ময়দানে আসার সময় মারা যাওয়া তিনজন হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার ধামাউরা গ্রামের ইউনুছ মিয়া (৬০)। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার চৌহদ্দীটোলা গ্রামের জামান মিয়া (৪০) ও ইজতেমায় আসার পথে বাসচাপায় পুলিশ সদস্য হাসান উজ্জামান (৩০) মারা যান।

বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সেলের প্রধান মো. হাবিবুল্লাহ রায়হান মৃত্যুর সংবাদগুলো নিশ্চিত করেন
যৌতুকবিহীন বিয়ে: টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন (শনিবার) বাদ আসর ৭২ জোড়া বর-কনের যৌতুক বিহীন বিয়ের নিবন্ধন হয়েছে। ইজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য ও মিডিয়া সমন্বয়ক মুফতি হাবিবুল্লা রায়হান গনমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চত করেছেন। পারস্পরিক সম্মতিতে বরেরা মূল বয়ান মঞ্চের সামনে উপস্থিত হন আর কনেরা নিজেদের গৃহে অবস্থান করেন। বিয়ে শেষে উপস্থিত মুসল্লিদের মাঝে খুরমা খেজুর বিতরণ ও দোয়া করা হয়। যৌতুক বিহীন বিয়ে পড়ান ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাছান হাফি:।

ইজতেমা ময়দান থেকে ৪১ হকার আটক:
ইজতেমা ময়দানে এলোমেলো ভাবে দোকান বসিয়ে যানজট সৃষ্টির অভিযোগে টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে ৪১ জন হকারকে আটক করেছে। শনিবার সকাল ১১ টায় টঙ্গী পূর্ব পশ্চিম থানায় খোঁজ নিয়ে এই তথ্য জানা যায়।
পাঁচ শতাধিক বিদেশীকে ট্যুরিস্ট পুলিশের জরুরী সেবা:

ট্যুরিস্ট পুলিশের ঢাকা রিজিয়নের পুলিশ সুপার নাইমুল হক পিপিএম বলেন, বিশ্ব ইজতেমায় আমরা শতাধিক সদস্য মোতায়েন করেছি। সাদা পোষাকে আছে ২০ জন। আমরা ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক বিদেশী নাগরিকদের সেবা প্রদান করেছি। বৃহস্পতিবার রাতে কোরিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয় একজন নাগরিক ইজতেমা থেকে তার ব্যাগ, পাসপোর্ট ও নগদ ৬০ হাজার টাকা হারিয়ে ফেলে। আমরা খবরটি জানার সাথে এক ঘন্টার মধ্যে হারানো মালামাল খুঁজে বের করে দিয়েছি। এ ছাড়া বিদেশী নাগরিকদের যাতায়ত, সুবিধা অসুবিধা, ডলার ভাঙানো সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করছি আমরা।
এসময় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আরো উপস্থিত ছিলেন ট্যুরিস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার ( মিডিয়া এন্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) ফুয়াদ সাকিব, ট্যুরিস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ পরিদর্শক মোঃ গোলাম মোস্তফা পিপিএম, গাজীপুর জোনের অফিসার ইনচার্জ মোঃ গোলাম কিবরিয়া।

ডিএমপির এক লাখ পানির বোতল বিতরণ:
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপির উত্তরা বিভাগ গতকাল শনিবার বিকেলে মুসল্লিদের মাঝে এক লাখ বোতল খাবার পানি বিতরণ করেছেন। এসময় ডিএমপির উত্তর বিভাগের ডিসি সহ অন্যান্য কর্মকর্তরা উপস্থিত ছিলেন।
চিকিৎসা সেবা: টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ৭২৯জন মুসল্লি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে ১৯ জনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে এবং ৭ জনকে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক। এছাড়া ইজতেমাস্থলের পার্শ্ববর্তী ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলোতে কয়েক হাজার মুসল্লি বিভিন্ন রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।

বিদেশী মুসল্লিদের অংশগ্রহণ: ইজতেমার প্রথম পর্বে শনিবার বিকেল পর্যন্ত ভারত, পাকিস্থান, কুয়েত, সৌদিআরব, আফগানিস্থান, জাপান, ওমান, কানাডা, মোজাম্বিক, মালয়েশিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, কিরগিস্থান, সিঙ্গাপুর, ইটালী, জর্ডান, যুক্তরাজ্য, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, ইরান, সৌদি আরব, কানাডা, চাঁদ, স্পেন, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখাস্তান, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক দেশের ৩ সহ¯্রাধিক মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে হাজির হয়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। বিভিন্ন ভাষা-ভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশী মেহমানদের ভিন্ন ভিন্ন তাবু নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

এদিকে আখেরি মোনাজাত শেষে এ পর্বে আগত মুসল্লিরা ময়দান ত্যাগ করবেন। আখেরী মোনাজাতে বেশ কয়েকজন ভিআইপি অংশগ্রহন করবেন বলে জানা গেছে। পরে মাওলানা সা’দ আহমাদ কান্ধলভী পন্থী মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের অনুসারী মুসল্লিরা ময়দানে প্রবেশ করে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় অংশ নিবেন। ১১ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে দ্বিতীয় পর্ব তথা এবারের বিশ্ব ইজতেমার ৫৭তম আসর। লোক সমাগম বৃদ্ধি করে নিজেদের অনুসারী সংখ্যা দেখানোর একটি নীরব প্রতিযোগীতা দু’পক্ষের মধ্যেই চলমান রয়েছে বলে অনেক মুসল্লি জানিয়েছেন। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম ধাপে মুসল্লি সংখ্যা বেশী হওয়ায় রাস্তার পাশ, অলি-গলি, বাসাবাড়ির ছাঁদ এমনকি পাঁকা টয়লেটের ছাঁদেও মুসল্লিরা রাত্রি যাপন করছেন। এ পর্বের দ্বিতীয় দিনেও ইজতেমাস্থলে মুসল্লিদের আগমনের ঢল অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে শিল্পনগরী টঙ্গী নিরাপত্তার চাঁদরে মোড়া ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত ময়দান অভিমূখে মানুষের আগমন ¯্রােত অব্যাহত থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *